বাউল শিল্পী রীতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। কিন্তু মাননীয় আদালত, তাঁকে গ্রেপ্তারের আগে, তাঁকে বিচারে দন্ডিত করার আগে বাংলাদেশে পালাগানকে নিষিদ্ধ করতে হবে। নইলে রীতা দেওয়ানকে দ-িত করাটা সম্পূর্ণ অবৈধ ও অন্যায় হবে। নইলে প্রশ্নের সম্মুখীন হবে বিচার বিভাগের ন্যায়-নীতি। নইলে বিচার বিভাগ প্রশ্নের সম্মুখীন হবে বাংলার ‘লোকদাশনিক’দের কাছে, হাজার বছরের বাংলা গানের কাছে। এবং অনাগত কালে যারা সংগীত-সাধনায় আসবেন, তাঁরা প্রত্যেকে বিচার বিভাগের প্রতি প্রশ্নের আঙুল তুলবেন। কেন? কারণ পালাগান বাংলাদেশে নিষিদ্ধ নয়। বৈধ। সেই বৈধ কাজটি করেছেন রীতা দেওয়ান। যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তবে তা রীতা দেওয়ানের নয়, বাংলার ঐতিহ্যবাহী পালাগানের।
পালাগান কী? এক ধরনের বিতর্কমূলক গান, যেখানে দুটি পক্ষ থাকে। একটি বিষয় নির্বাচন করে দুই পক্ষ বিষয়টির ওপর কথা ও গানে বিতর্ক করেন। যেমন ধরা যাক পালাগানের একটি বিষয় ‘পানি’। প্রথম পক্ষ কথায়-গানে পানির পক্ষে বলবে, দ্বিতীয় পক্ষ বলবে বিপক্ষে। ধরা যাক প্রথমে মঞ্চে উঠলেন পানির পক্ষের গায়েন দিলারা সরকার। দোহাররা ঢাক-ঢোল-মৃদঙ্গ বাজাবেন। দিলারা বেহারা বাজিয়ে কথায়-গানে বলবেন, ‘পানির অপর নাম জীবন। পানি খাওয়া ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। পানিতে মাছ থাকে। এই মাছ খেয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। নদী, পুকুর, জলাশয়ে পানি থাকে। পানি থাকে বলেই সুন্দর শাপলা-শালুক থাকে। পানি আছে বলেই এই প্রকৃতি এমন সবুজ-সুন্দর। পানি খেয়ে শুধু মানুষ নয়, প্রত্যেক প্রাণী বেঁচে আছে। পানি না থাকলে চাষাবাদ করা যেত না। সব জমি শুকিয়ে পাথর হয়ে যেত। দেশে দুর্ভিক্ষ শুরু হয়ে যেত। পানি ছাড়া ভাত-তরকারি রান্না করা যায় না। রান্না না করে খাবার কাঁচা খাওয়া যায় না। পানি ছাড়া গোসল করা যায় না। গোসল না করলে শরীরে রোগ-ব্যাধি বাসা বাঁধে।’
দিলারা সরকার পানির পক্ষে এরকম বিস্তর যুক্তি উপস্থাপন করে বসে যাবেন। এবার মঞ্চে উঠবেন বিপক্ষের দলের গায়েন শফিক সরকার। দোহররা ঢাক-ঢোল-মৃদঙ্গ বাজাবেন। শফিক সরকার বেহালা বাজিয়ে কথায়-গানে বলতে শুরু করবেন, ‘পানি খুব খারাপ পদার্থ। সৃষ্টির শুরুতে এই বিশ^ব্রহ্মা-ে কেবল পানি আর পানি ছিল। ¯্রষ্টা জল সরিয়ে স্থল সৃষ্টি করলেন। কেন করলেন, জলে মানুষ থাকতে পারে না, স্থলে পারে। সুতরাং স্থলই শ্রেষ্ঠ। পানিতে কুমির বাস করে, হাঙর বাস করে, সাপ-খোপ বিষধর প্রাণী বাস করে। পানির কারণে প্রতি বছর দেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। বন্যায় ক্ষেত-ফসল ধ্বংস হয়, ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট নষ্ট হয়, দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়। পানির কারণে আকাশে মেঘ জমে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণ হয়ে বজ্রপাত হয়। বজ্রপাতে মানুষ ও পশুপাখি মারা যায়। পানি বৃষ্টি হয়ে আকাশ থেকে ঝরে। এ কারণে বৃষ্টির দিনে মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছাতা কিনতে হয়। এটা একটা বাড়তি খরচ। বৃষ্টিতে ভিজে মানুষের অসুখ-বিসুখ হয়। মদ বানাতে পানিও লাগে। মদে তরল পদার্থ পানিও থাকে। মদ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মানুষের মূত্রও পানি। এই পানি দুর্গন্ধ ছাড়ায়। সুতরাং পানির মতো খারাপ পদার্থ জগতে আর কিছু নেই।’
পালা শেষ? না। এবার দুই পক্ষের দুই গায়েন দিলারা সরকার ও শফিক সরকার মঞ্চে উঠবেন। তারা কথায়-গানে এবার ঐক্যমতে পৌঁছবেন যে, পানি মোটেই খারাপ পদার্থ নয়, ভালো পদার্থ। পানি সৃষ্টির জন্য কল্যাণকর। প্রত্যেক জিনিসেরই ভালো-মন্দ দুটি দিক থাকে। পানিরও তাই। আগুনেরও তাই। মাটিরও তাই। মানুষেরও তাই। পশু-পাখিওর তাই। কিন্তু গ্রহণ করতে হবে ভালোটাকে, মন্দটাকে নয়। পানি নিয়ে দুজনের মধ্যে আর কোনো মতভেদ থাকবে না। তারা কোলাকোলি করবেন। দর্শক-শ্রোতারা হাততালি দেবেন। দোহররা ঢাক-ঢোল-মৃদঙ্গ বাজিয়ে পালা শেষ করবেন।
এখন কোনো শ্রোতা যদি গোটা পালাটি না দেখে, দুই পক্ষের দুটি পালা না শুনে শুধুমাত্র পানির বিপক্ষের পালাটি শুনে পালাকার শফিক সরকারকে মূর্খ বলেন, তার নিন্দা করেন, সেটা কি উচিত হবে? মোটেই না। কারণ তিনি পালার অর্ধেকটা শুনেছেন, খ-িত যুক্তি শুনেছেন। পানির পক্ষের পালা শোনেননি। শেষে যে দুজন ঐক্যমতে পৌঁছেছেন, তাও শোনেননি। সে কারণে সমস্যাটা পালাকারের নয়, খ-িত শ্রোতার।
পালাগানের এই ধারাটি দেখা যাবে বাউল গানেও। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ সিনেমায় ‘প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর’ শীর্ষক একটি গান আছে। গানটি ভালো করে শুনলে বোঝা যাবে বাউলরা গানে গানে কেমন করে বিতর্ক করেন। সেই গানে শরিয়তপন্থি নারী বাউলটি বলছেন :
‘আমি আপনার মেয়ের বয়সী শরিয়তের হইয়া
মারিফতের বিষয় কিছু শাওয়াল যাব গাইয়া
বেয়াদবি নিবেন না দেইখা আমার ভান
হাদিস কোরান মানেন না কেমন মুসলমান?
মোল্লা-মুন্সি ক্ষ্যাপা কেন আপনাদের উপর?’
মারিফতপন্থি পুরুষটি উত্তরে বলছে :
‘কোরান হাদিস বুঝতে কিছু জ্ঞানের প্রয়োজন
দুই পাতা সিপারা পইড়া বুঝবে কী মদন?
নিজেরাই বুঝে না অন্যরে বোঝায়
সব লোকেরে ভুল বুঝাইয়া কাঠ মোল্লারা খায়
বেহেশতের লোভ করি না হায় নাই দোযখের ডর গো
প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর।’
এবার নারীটি আবার প্রশ্ন রাখছে :
‘ফকিরেরা জিকির করে নামাজ ফাঁকি দিয়া
রোজার দিনে গাঁজা টানে ধ্যানেরই নাম নিয়া
হজ¦ যাকাত করেন না, না হয় নিলাম মানি
কী প্রবলেম করছে আপনার বলেন কোরবানি?
রক্ত দেখলে কাঁপবে কেন মুসলিমের অন্তর?’
পুরুষটির জবাব :
‘কুরবানি করতে হুকুম প্রাণ-প্রিয় ধন
গরু-ছাগল হইল কি তোর এতই প্রিয়জন?
নিজের থাইকে প্রিয় বস্তু আর যে কিছু নাই
আত্মত্যাগই আসল কুরবান জেনে নিও ভাই
দশ ইন্দ্রিয় ছয়টি রিপু পারলে দমন কর গো
প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর।’
নারীটির আবার প্রশ্ন :
‘ছেরি নিয়া বেড়ান ঘুরি নিকা না করিয়া
একসাথে নাচেন গান বেপর্দা হইয়া
পুরুষ পোলার জন্য বাহির নারীর জন্য ঘর।’
পুরুটির উত্তর :
‘মাইয়া হইল আদি বস্তু, সৃষ্টি যারে দিয়া
ভেদাভেদ করে যারা তারাই করে বিয়া
মাইয়া হয় প্রেমের ভা- মাইয়া হইল মা
মাইয়া না হইলে ভবে আমরা আসতাম না
সৃষ্টি করতে দুইটি লাগে নারী আর নর।’
এবার দুজনেই ঐক্যমতে পৌঁছে যৌথকণ্ঠে গাইছেন :
‘যদি আল্লাহর সন্ধান চাও গো
প্রেম রাখিও অন্তরের ভিতর।
যদি বেহেস্তে যেতে চাও গো
অন্তরে রাইখো আল্লার ডর।’
হিন্দু-বৈষ্ণব পালাকাররাও শিব-পার্বতী, রাধা-কৃষ্ণসহ হিন্দু ধর্মের নানা কিছুকে বিষয় করে পালাগান, তর্জাগান, কবিগান গেয়ে থাকেন। ধারা যাক পালার বিষয় ‘শিব ও অসুর’। একজন শিবের পক্ষে গাইবেন, একজন অসুরের পক্ষে। অসুরের পক্ষের গায়েন বলবেন, ‘শিবের তো তিনটা চোখ। শিব দেখতে কেমন কুৎসিৎ! তিনি পশুর চামড়া পরে থাকেন। ব্রহ্মদেব, বিষ্ণুদেব, ইন্দ্রদেব, চন্দদেব, সূর্যদেব, বরুণ দেব, কুবের দেব প্রমুখের মতো তার মাথায় মুকুট নাই। শিব তৃতীয় নয়ন দিয়ে কামকে ভষ্ম করেছেন। কেন করলেন? কামের কী দোষ? কাম না থাকলে মানুষ সৃষ্টি হবে কেমন করে? শিবের মাথায় বিরাজ করে অর্ধচন্দ্র। কেন চাঁদকে তিনি কেন মাথায় রাখবেন? এ কেমন স্বার্থপরতা? শিব তার সর্বাঙ্গে বিভূতি বা ভস্ম মাখেন। মাখার জিনিস আর পেলেন না তিনি? ¯েœা-পাউডার মাখলে কী ক্ষতি? শিব থাকেন শ্মশানে। কেন? জগতে কি থাকার অভাব? শ্মশানে তো প্রেতাত্মারা থাকে। তার মাথায় মস্ত জটা, গলায় নীল দাগ। এই যদি শিবের মতো একজন দেবতার বেশভূষা হয়, তাহলে তার ভক্তরা তাকে কেমন করে ভক্তি করবে?
এবার মঞ্চে উঠবেন শিবের পক্ষের গায়েন। শিবের তৃতীয় চক্ষুর মহাত্ম্য বর্ণনা করবেন তিনি। শিব কেন কামকে ভষ্ম করেছিলেন তার ব্যাখ্যা দেবেন। শিভ অর্ধচন্দ্র মাথায় রাখেন, কেন তিনি গায়ে ভষ্ম মাখেন, কেন তার চুলে জটা, সব কিছুর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করবেন তিনি। অবশেষে দুজনেই ঐক্যমত্যে পৌঁছবেন যে, শিব হচ্ছেন দেবাদিদেব। তিনি জগতপিতা। তিনিই পরম ব্রহ্ম। তাঁর তুলনা তিনিই।’ দুজনেই গেয়ে উঠবেন, ‘ওঁ শিবায়ে নমঃ।’
রীতা দেওয়ানের ঘটানাটিও হবহু এমনই। বাংলা পালাগানের একটি ঐতিহ্যবাহী বিষয় হচ্ছে ‘আল্লাহ ও ইবলিস’ বা ‘আদম ও শয়তানের পালা’। দুটি বিপরীত সত্তার পালা। এ বিষয়ে একপক্ষ অবস্থান নেয় আল্লাহর পক্ষে, আরেক পক্ষ শয়তানের পক্ষে। এমন একটি পালাগানের আসারের বর্ণনা দেওয়া যাক। পালাগান শুরু হয়েছে। এক পক্ষের গায়েন শাহীন সরকার, আরেক পক্ষের রীনা সরকার। প্রথমে ‘শয়তানের পালা’ গাওয়ার জন্য মঞ্চে উঠলেন শাহীন সরকার। শাহীন সরকার বেহালা হাতে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। ঢোল তবলা বাঁশি হারমোনিয়াম জুড়ির সমবেত বাজনা চলল কতক্ষণ। তারপর শুরু হলো গান, মানে পালা। পালার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এই যে, আদমসৃষ্টির শুরু প্রসঙ্গে গায়েন বলতে শুরু করলেন, ‘আল্লাহ আদম সৃষ্টির জন্য তিনবার ফেরেশতাদের পাঠালেন পৃথিবী থেকে মাটি নেওয়ার জন্য। কিন্তু মাটি প্রতিবাদ করল। পৃথিবী মাটি দিতে নারাজ। তৃতীয় বারের সময় আল্লাহ খোদ আজরাইল ফেরেশতাকে পাঠালেন মাটি নেওয়ার জন্য। আজরাইল তার সর্বগ্রাসী শক্তি দিয়ে মাটির তীব্র প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে মাটি নিয়ে হাজির হলো আরশে আজিমে।’ এখানে এসে গায়েন প্রশ্ন করলেন, ‘আল্লাহ তো সর্বশক্তিমান। তার শক্তির কাছে মাটি কোন ছার! তিনি যদি সর্বশক্তিমান হয়েই থাকেন, পৃথিবীর সব কিছু যদি তারই নির্দেশ মেনে চলে, তবে মাটির এত বড় দুঃসাহস হলো কী করে যে, সে মাটি দিতে প্রতিবাদ করল?’
গায়েন বয়ান করে চলেন, ‘মানব জাতি সৃষ্টির আগে আল্লাহ প্রথমে পৃথিবীতে জিন জাতি সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তারা পাপাচারে এত বেশি লিপ্ত হয়ে পড়ল যে আল্লাহ তাঁর গজবের ফেরেশতাদের নির্দেশ দিলেন পৃথিবীর সকল জিন জাতি ধ্বংস করে দিতে। ফেরেশতারা তাঁর নির্দেশ মোতাবেক ধ্বংসলীলায় মেতে উঠল। পৃথিবীর সব জিন ধ্বংস হলো। কিন্তু ফেরেশতাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু জিন পাহাড়ে, জঙ্গলে, গুহায় আশ্রয় নিয়ে ফেরেশতাদের রোষানল থেকে রেহাই পেল।’ গায়েন প্রশ্ন করলেন, ‘আল্লাহ তো সর্বদ্রষ্টা। পৃথিবীতে এমন কিছু নেই যা তাঁর অগোচরে। তাই যদি হয় তবে কিছু জিন যে পাহাড়ে, গুহায়, জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে জানে বেঁচে গেল, তিনি তা দেখলেন না কেন? দেখেছেন, নাকি দেখেও না দেখার ভান করেছেন।’ গায়েনের প্রশ্ন, ‘এটা কি ন্যায় বিচার হলো আল্লাহর?’
গায়েন বয়ান করে চলেন, ‘আজরাইলের নেতৃত্বে গজবের ফেরেশতারা জিন জাতি ধ্বংস করে আসমানে ফিরে যাচ্ছিল। যাবার পথে দেখল আড়াই হাজার বছর বয়সী এক জিনশিশু তার স্বজন-পরিজন হারিয়ে পথের ধারে একা বসে কাঁদছে। তাকে দেখে আজরাইলের মায়া হলো। আজরাইল তাকে উঠিয়ে নিয়ে গেল আসমানে। শিশুটির কথা সে আল্লাহর গোচরে আনলো। আল্লাহ তার অধীনস্ত অন্যতম ফেরেশতা আজরাইলের ইচ্ছাকে অবজ্ঞা করলেন না। কিন্তু আসমানে এই জিনশিশু খাবে কী? না খেলে তো সে বাঁচবে না! তাই আল্লাহর হুকুমে তার জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থা করা হলো। শিশু তার তর্জনী চুষলে দুধ বের হবে আর মধ্যমা আঙুল চুষলে মধু বের হবে। এভাবে অলৌকিক দুধ আর মধু খেয়ে খেয়ে মকরম বা আজাজিল বড় হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। আল্লাহর রহমত পাওয়ার আশায় সে এবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকল। সাত আসমানের এমন কোনো জায়গা বাকি থাকল না যেখানে আজাজিলের সেজদা পড়ল না। তার এবাদত-বন্দেগিতে খুশি হয়ে আল্লা জাতিভেদ প্রথা বিলুপ্ত করে আগুনের তৈরি আজাজিলকে নূরের তৈরি ফেরেশতাদের সর্দার বানিয়ে দিলেন। যাকে বলে মুয়াল্লিমুল মালায়েকাহ। আযাযিল যথারীতি ফেরেশতাদের নেতার পদ অলঙ্কৃত করে তাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে লাগল। তার উপর আল্লাহর হুকুম এলো, সে যেন ফেরেশতাদের বলে দেয় যে, সে এবং ফেরেশতারা আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুকে যেন সেজদা না করে। আল্লার ফরমান যথারীতি পালন করতে লাগল আযাযিল ও তার অধীন ফেরেশতারা।’
‘তারপর আল্লাহ আদম সৃষ্টি করলেন। আদমের ভেতর যখন আল্লা রুহ দিলেন তখন ফেরেশতাদের নির্দেশ দেওয়া হলো তাকে সেজদা করতে। সব ফেরেশতা সেজদা করল, কিন্তু আযাযিল দাঁড়িয়ে রইল। হুকুম অমান্য করার কৈফিয়ত তলব করলেন আল্লাহ।’ গায়েন বলে চলেন, ‘আযাযিল বলল, হে আল্লা, আপনিই তো নিষেধ করেছেন আপনি ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে যেন সেজদা না করি। আমি আপনার কথার অবাধ্য হইনি কখনো। আপনাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে সেজদা করি কিভাবে? এখন আপনি আবার বলছেন মাটির আদমকে সেজদা করতে। শুনেছি হাকিম নড়ে কিন্তু তার হুকুম নড়ে না। আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি সর্বশক্তিমান। আপনি যখন-তখন পূর্বনির্দেশ বাতিল করে নতুন নির্দেশ জারি করতে পারেন। কিন্তু তার আগে তো আপনার মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সদস্যদের সঙ্গে একটু আলাপ আলোচনার দরকার ছিল, যেভাবে আলাপ-আলোচনা করেছিলেন আদম সৃষ্টির আগে। কিন্তু এখন কারো সঙ্গে আলাপ না করে আপনি যে মনগড়া নির্দেশ দিয়ে দিলেন এটা কি গণতন্ত্র হলো? তাছাড়া আপনি আগে বলেছেন কী, আর এখন বলছেন কী? আপনি তো আল্লাহ। আপনার হবে এক জবান। আপনি এক জবানে দুই কথা বলেন কীভাবে? শয়তান আমি নাকি আপনি?’
এরপর মঞ্চে উঠলেন রীনা সরকার। শাহীন সরকার যে যে অভিযোগগুলো উত্থাপন করেছেন, সব খ-ালেন তিনি। প্রত্যেকটি অভিযোগের উত্তর দিলেন। তারপর দুজনেই ঐক্যমতে পৌঁছলেন। আল্লাহার মহত্ব ঘোষণা করলেন। বললেন, ‘আল্লাহ যা কিছু করেন সবই ভালোর জন্য করেন। সাধারণ মানুষের চোখে আল্লাহর সেই ভালো কাজটি কখনো কখনো মন্দ ঠেকে। মূলত তা মন্দ নয়। মন্দ ঠেকাটা মানুষের সমস্যা, মানুষের দুর্বলতা, আল্লাহর নয়।’ দর্শক-শ্রোতারা তখন হাততালি দেবেন।
এখন কেউ যদি শুধু শাহীন সরকারের পালাটি শুনে তাঁকে ধর্মদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করেন, সেটা কি ন্যায়সঙ্গত হবে? হবে না। ঘোর অন্যায় হবে। রীতা দেওয়ানও তাঁর আসরে ইবলিশের পালাটি গেয়েছিলেন। কে বা কারা পুরো আসরটি ইউটিইউবে আপলোড না করে শুধু আপলোড করল ইবলিশের পালাটি। সেই পালাটি দেখলেন আইনজীবী ইমরুল হাসান। জীবনে কোনোদিন তিনি পালাগানের আসরে যানননি, পালাগান সম্পর্কে তার কোনো ধারনা নেই, পালাগান কী তিনি তা বোঝেন না। রীতা দেওয়ানের কথাগুলো শুনে তার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগল। আঘাত লেগেছে, কী করা যায়? কী আর করবেন, ডিজিটাইল আইন তো আছেই। আদালতে দিলেন রীতা দেওয়ান ও তাঁর দুই সহশিল্পীর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে। আদালত জারি করে দিলেন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
মাননীয় আদালত, আপনিই বলুন দোষ কার? রীতা দেওয়ানের, না পালাগানের? আদম ও শয়তানের পালাটি তো কয়েক শ বছর ধরে বাংলার বিভিন্ন আসরে গীত হয়ে আসছে। যারা এ ধরনের আসরের দর্শক-শ্রোতা তাদের কাছে এ গানের বিষয়বস্তু দোষণীয় কিছু নয়। শত শত বছর ধরে তারা শুনে আসছে। শুনতে শুনতে তারা অভ্যস্ত। এত বছর এই পালার বিরুদ্ধে কেউ বলেনি, এখন কেন হলো? এত বছর এই পালায় দোষ ছিল না, এখন কেন দোষ হলো? কারণ এখন ইউটিউব এসেছে দেশে। পালাগানও এখন রেকর্ড হয়ে ইউটিইউবে চলে যাচ্ছে। কখনো পুরোটা, কখনো অর্ধেকটা। কোনো দর্শক কাঁটছাট করা অর্ধেকটা শুনেই মাথা গরম করে ফেলছে। তার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগে যাচ্ছে। পালাগানের ধারা না বুঝেই তিনি আহত-নিহত হয়ে যাচ্ছেন।
তাই মাননীয় আদালতের কাছে আমাদের বিনীত আবেদন, রীতা দেওয়ানের কোনো দোষ নেই। দোষ হয়ে থাকলে তা পালাগানের। পালাগানকে আগে নিষিদ্ধ করে দিন, তারপর রীতা দেওয়ানকে দ- দিন। নইলে রীতা দেওয়ানকে দোষী সাব্যস্ত করাটা অন্যায় হবে। চিরকালের জন্য আদালতের ন্যায়-বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর শুধু পালাগান কেন, কোনো গানই থাকার দরকার নেই দেশে। তর্কহীন, প্রশ্নহীন, গানহীন, নৃত্যহীন, কৃত্যহীন, নাটকহীন, সিনেমাহীন একটি জাতি গঠনই যেহেতু আমাদের পরম লক্ষ্য, সুতরাং কিছুই রাখার দরকার নই। সবই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হোক। বাঙালি হয়ে উঠুক রোবট জাতি।
(লেখকের ফেইসবুক থেকে নেয়া)