1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

জফির সেতু এবং এক স্মারকসংবাদ ।। আবিদ ফায়সাল

  • আপডেট টাইম :: সোমবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭.৪২ এএম
  • ২৭১ বার পড়া হয়েছে

বাংলা কবিতাবিশ্বের অবিশ্রান্ত ও অভিজাত অভিযাত্রী জফির সেতু। মানুষের ইতিহাস হাতের তালুতে ধারণ করে কবিতা লেখেন এই পর্যটন-প্রিয় কবি। আজ তাঁর জন্মদিন। পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করেছেন তিনি। ২০২১ সালের এমন দিনে আমরা তাঁর সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবো। আপাদমস্তক সাহিত্যব্রতী ও শিল্পনিমগ্ন এই বহুচারী সেতুর শুভক্ষণে সর্ববিধ কল্যাণ কামনা করি। জীবনের প্রাপ্তি স্বর্গের সমান হোক।

জফির সেতুর কথা মনে এলে তাঁর স্বয়ম্ভর জীবনের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে; সৃষ্টিশীল কর্ম নিয়ে ভাবতে মন চায়; হৃদয়ের অসীম সীমানা স্পর্শ করতেও বাসনা জাগে। কিন্তু কেন?—এর নানাবিধ কারণ আছে। তাঁর সমসময়ের বা নিকটবয়েসি একজন মানুষ হিশেবে, তাঁর উষ্ণ হৃদয়ের ঔদার্য ও সারল্যে মুগ্ধ এবং প্রখর বুদ্ধির বিশেষ গুণগ্রাহী হওয়ার কারণে। তাঁর সঙ্গ বা ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য আমি পেয়ে আসছি আড়াই-তিন দশকের মত—সে-এক দুর্মর ভালোবাসা এবং সুখদুঃখের আখ্যানপর্ব। এখানে আপাত সে-কথা উহ্যই থাকুক।

কৃতবিদ্য জফির সেতু—কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার ও প্রবন্ধ লেখক। নিছক প্রবন্ধ লেখক নন, বিবেকী চিন্তক।

গোটা মানুষের একজন হয়ে কোনও কোনও ব্যক্তি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। জফির সেতুকে এমন কয়েকটি দায়িত্ব পালনে আমরা প্রত্যক্ষ করি।
‘সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের ইতিহাস’, ‘স্ত্রীশিক্ষার উন্মেষপর্ব ও সিলেট মহিলা কলেজ’ শিরোনামে দুটি গ্রন্থ রচনা করে তিনি প্রমাণ করেছেন শুধু একজন কবি-কথাসাহিত্যিক কিংবা একজন সাহিত্যের ছাত্র-বা শিক্ষক নন, তিনি ইতিহাসবেত্তাও। ইতিহাসও তাঁর নেড়েঘেঁটে জানার আর বিবেকী সত্তার আধার।

সিলেটে রবীন্দ্র আগমনের শতবর্ষ উদযাপনেও জফির সেতু বিদগ্ধ দায়িত্ব ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ, বরিশালসহ প্রভৃতি শহরে ভ্রমণে এসেছিলেন কিন্তু শতবর্ষপূর্তি যাপন কোথাও করা হয়নি, সিলেট ব্যতীত। শতবর্ষ রবীন্দ্রচর্চার গ্রন্থিত দলিলও নেই। জফির সেতু রবীন্দ্র- মূল্যায়নের ধারায় সিলেট-মনীষার শতাধিক বছরের উজ্জ্বলতম অনুধ্যানের স্মারক ‘শ্রীভূমির রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থ সম্পাদনা ও সংকলিত করেছেন। রবীন্দ্রচর্চার ক্ষেত্রে যা অন্য অনেক অঞ্চলের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।

সিলেটের মুরারিচাঁদ ও সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে যে দুটি সেমিনার হয়, এরও সঙ্গে বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন জফির সেতু। তাঁর মেধাবী ভূমিকার আরেকটি মহার্ঘ দলিল ‘মুরারিচাঁদ কলেজ জার্নাল’। ‘রবীন্দ্রনাথ ও দক্ষিণ এশিয়া’ শীর্ষক সেমিনারে পঠিত বাংলা ও ইংরেজি দুটি অংশে মোট তেরোটি গবেষণা-প্রবন্ধ এতে স্থান পেয়েছে। জফির সেতু এই জার্নাল সম্পাদনার সঙ্গে যুক্তছিলেন।

মাধ্যমিক পাঠ্যপুস্তকের লেখক ও সম্পাদক হিশেবে তাঁর সৃজনশীল মন ও মননের স্বাক্ষর রয়েছে। ছোটোকাগজের পরিশ্রমী সম্পাদক হিশেবেও তাঁর একটা নির্মোহ সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞা ও সাংগঠনিক পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি সম্পাদনা করছেন ছোটোকাগজ ‘সুরমস’ ও গোষ্ঠীপত্রিকা ‘কথাপরম্পরা’।

গবেষণাকর্মে তাঁর বিশেষ-বিশিষ্ট খ্যাতি রয়েছে। সমাজভাষাবিজ্ঞানের ওপর তিনি লাভ করেছেন পিএইচ.ডি ডিগ্রি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে করছেন শিক্ষকতা। প্রজ্ঞাবান অধ্যাপক হিশেবে তিনি অনায়াসে আমেরিকা-কানাডা-কিংবা ইউরোপের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে পারতেন। করতে পারতেন নিরাপদ জীবনযাপন। কিন্তু বিদেশে পাড়ি দিতে চাননি তিনি। যেমন বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিসে ক্যাডার ভুক্ত হয়েও তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি। বিদেশযাপনেও তাঁর একটা অনীহা। নির্লোভ জীবন আর শিল্পচর্চা করতেই তাঁর শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্তি। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তাঁর দায় রয়েছে। এদেশের মাটি ও মানুষকে তিনি ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন বলেই তিনি শুধু শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক নন, কর্তব্যানুরাগ ও শিক্ষানুরাগ থেকে দায়িত্ব পালন করছেন স্কুল ও কলেজ পরিচালনা। গড়ে তুলেছেন নিজ গ্রামে বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান।

জফির সেতু একজন আমর্ম সমাজভাবুক—তীক্ষ্ণোজ্জ্বল সমালোচক। সংকটে-সংগ্রামে কলম ধরেন। রাজপথে পা রাখেন। ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মত তিনিও হাঁটতে হাঁটতে লিখেছেন স্মরণীয় দীর্ঘ বিক্ষুব্ধ কবিতা : ইউ ব্লাডি বাস্টার্ড। বৈশ্বিক সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উত্থানই কবিতার কেন্দ্রীয় সূত্র। পরপর এ-নামেই প্রতিরোধ পুস্তিকাও বেরিয়েছে। তখন শহরে শহরে গণজাগরণমঞ্চ গড়ে উঠেছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে চলছে আন্দোলন। অন্যদিকে জঙ্গিবাদীদের চলছে হত্যাযজ্ঞ। সেসময়ে ছিল তাঁর এই সাহসী উচ্চারণ। কবিতাটি তাঁর দ্রোহীচেতনার রক্তাক্ত দলিল। একান্ত উদ্যোগ নিয়ে কেউ এর প্রেক্ষাপট কবির কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন।

তিনি দলানুগত্যের নন, জীবনকে স্বীকার করে শিল্পানুগত্যের কবি। তাঁর প্রথম ও প্রধান পরিচয়—কবি। সেতুর কবিতা তাঁর সৃষ্টিবিশ্বে পৌঁছবার একটা সেতুও। ‘বহুবর্ণ রক্তবীজ’ তাঁর ভিন্নধর্মী কাব্যচর্চার বীজও।শুরু হয় বীজ থেকে বৃহতের, ফসলের অনুসন্ধান। এই বীজ আজ ফুলফসলের জৈবতা পেয়েছে। এ-পর্যন্ত তাঁর পনেরোটি কবিতাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এবং এক‌টি ইংরেজি কবিতার বই: Turtle has no wings (২০১৪)। এ-বছর তাঁর জন্মদিবসের প্রকাশনা : কবিতাসংগ্রহ (২০২০)। তাঁর কবিতার ফর্ম একটি থেকে অন্যটি আলাদা। বহুমুখী আঙ্গিক এবং প্রকরণে সমৃদ্ধ। ২০০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গ্রন্থের কবিতাগুলো অদ্যতন এবং চিরন্তন মনে হয়। একইসঙ্গে নিজস্ব বাচনরীতি গড়ে নিয়ে কবি নিজেকে চিনিয়ে দেন। তাঁর জরথুস্ত্রবাদ কবিতার দুটি পঙক্তি: — ডিমের কুসুমে যে-উষ্ণুতা ও চর্বি / আমি মূলত তারই প্রতিনিধি।

জীবনকে অস্বীকার করে নয়, পরম ঘনিষ্ঠ করে জফির সেতু লিখেছেন বিচিত্র বিষয় এবং বিভিন্ন স্বাদের কবিতা। তাঁর কবিতার প্রকরণ প্রাচ্য, পাশ্চাত্য ও সেমিটিক মিথের ব্যবহারে ঋদ্ধ। একইসঙ্গে তাঁর কবিতা শুধুই কবিতা নয়, কাব্যও। কোনও একটা পুরাণ কিংবা কাহিনিকে মহাকাব্যলোকের দিকে নিয়ে যাওয়ার দুর্দান্ত প্রচেষ্টা। পৃথিবীর সভ্যতা ও মানবেতিহাসের চিত্রটা তুলে ধরতে চান— আর এটা তাঁর কাব্যশক্তির স্বতন্ত্রবৈশিষ্ট্য।

সকল কবিই শব্দ দিয়ে রঙের কাজটা করতে পারেন না। জফির সেতু ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শন এবং পুরাণের গর্ভগৃহ থেকে তুলে আনেন কাব্যের অনুষঙ্গ, শব্দ ও বোধের কোলাজ। রূপদক্ষ কবির এক‌টা উদ্ধৃতি এখানে দিতে চাই —-
‘আঙুলের ফাঁক দিয়ে যে-তির ছুটে গিয়ে / কুরুক্ষেত্রে বিদ্ধ হয়েছিল দশম দিবসে / সহস্র বছর পর আজ দেখি তা এক সলজ্জ / কুমারীর স্তনের বোঁটায় লাল হয়ে ফুটে আছে। (উৎকীর্ণ, জাতক ও দণ্ডকারণ্য,২০১৩)

আরও এক‌টি কবিতার মাত্র দুলাইনে চোখ রাখা যাক —
‘আমরা আসলে গোধূলির ছায়ারূপে আরও একবার / সূর্যালোক ঠোঁটে করে পৃথিবীর অদ্ভুত তৃণে ও ঘাসে পা দিয়েছি।'(৫৮ সংখ্যক, ময়ূর উজানে ভাসো, ২০১৪)

—এই অভিব্যক্তি আমাদের আন্দোলিত করে, আনন্দ-বিহ্বল করে।

জফির সেতু কবিতার সঙ্গে সমউচ্চণ্ডতায়, বিচিত্র পথ ও গলিঘুপচি পরিভ্রমণ করে লিখেছেন গদ্য ‘কবিতার ইন্দ্রজাল’ (২০১৭)। প্রবন্ধগ্রন্থটি তাঁর কবিতাভাবনা ও সৃষ্টিচেতনার অনুপম বিশ্লেষণ এবং এর সুপ্রকাশ।

জফির সেতু একজন বলবন্ত আখ্যান লেখক। এপর্যন্ত তাঁর একটি গল্প এবং দুটি উপন্যাস গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘বাবেলের চূড়া’ (২০১৩) গল্পগ্রন্থের ব্লার্বে বলা আছে, ‘সমাজে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের আন্তঃসম্পর্কই শুধু উপস্থাপিত হয়নি, ব্যক্তি যে সমাজে বসবাসরত সেখানে প্রতি মুহূর্তে জীবনকে যাপন করার যে রাজনীতির ভেতর দিয়ে যায়, তাও খুব স্পষ্ট’। বস্তুত তাই। এই স্পষ্ট জীবনযাপন, তাঁর কাব্যানুষঙ্গিক গল্পভাষ্যে প্রবাহিত করে দিয়েছেন।

তাঁর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপন্যাস ‘হিজলের রং লাল'(২০১৬)। ‘এর বিস্তার সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে হালের গণজাগরণমঞ্চ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঔপন্যাসিক দেশভাগের শিকার উদবাস্তু চারপুরুষের একটি পরিবারের এমন এক মর্মন্তুদ আখ্যান নির্মাণ করেছেন, যা মানবিক সংকটে পূর্ণ, সে-অর্থে অস্তিত্ব-সংগ্রামেরও কাহিনি’। একইসঙ্গে যুদ্ধসময়ের রক্তগর্ভ উন্মোচনও।

জীবনের সঙ্গে যৌনতার এক দুঃসাহসিক ব্যতিক্রম আখ্যান ‘একটা জাদুর হাড়’ (২০২০)। এটি নিতান্ত গতানুগতিক ঘটনাপ্রধান বা প্রেম-কাম-প্রধানও নয় ; এর অন্তঃসৌন্দর্যের জায়গাটা হল—কাহিনির সমাপ্তি না টানা। কাহিনির জোর ও চরিত্রের ঘোরের সঙ্গে তাঁর উপন্যাস্থে একটা দার্শনিক ভাবনার পত্তন করেছেন ঔপন্যাসিক। জীবন তৃষ্ণায় মানুষ বাঁচার স্বপ্ন দেখে অন্তিমকালেও, এ-সত্যই প্রমূর্তন করে। গদ্যের বাঁধুনি বা প্রসাদগুণের কথাও বলতে হবে। কথনের আশ্চর্য ভঙ্গিমা ধরা পড়বে পাঠকমনে। শেষে বলি, এখানে অত্যুক্তি নয়, এমন আখ্যানকথন আমাদের কাছে যেমন স্বাতন্ত্র্য, লেখকও নিঃসঙ্গ। তাঁর সৃষ্টিসাধনা আশ্চর্য নিরীক্ষাসফল।

আজকের দিনে এই কথাগুলো লিখলাম, জফির সেতুকে জানার সুবিধের জন্য। তাঁর সুহৃদমণ্ডলীর একজন হয়ে।
জফির সেতুকে পড়া এবং জানা আমাদের একান্ত দায়িত্ব।
লেখক: আবিদ ফায়সাল, কবি ও ভ্রমণ লেখক।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!