করোনা কালীন অনেকেই চাকুরী হারিয়েছেন, ব্যবসায় লোকসান গুনেছেন, শেষ-মেষ ফিরে গেছেন গ্রামে। নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন নিয়ে ছোট-বড় ব্যবসার পাশাপাশি অনেকে কৃষি কাজে নিয়োজিত হয়েছেন বা কৃষি পণ্য বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছেন। যেহেতু বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ সেহেতু ঘুরে-ফিরে ‘কৃষি’তেই ফিরে যেতে হয়েছে তাদেরকে। লেখাটি আমি ২/১ বছর আগে থেকে লিখবো লিখবো করে লিখার সুযোগ করে উঠতে পারছিলাম না। তবে বর্তমান সময়ে তা প্রকাশ করা যথার্থ মনে করছি বলে কলম হাতে নিয়েছি অবশেষে।
সে যাক, গ্রামে যারা ফিরে গেছেন তাদেরকে আমার সাধুবাদ। এর সাথে আমাদের জন্য আসলেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে মাটির কাছাকাছি থাকা। কারণ বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক। এদেশের মাটি, জলবায়ু ইত্যাদি কৃষিকাজের উপযোগী বলে কৃষি পণ্যের ব্যবসা তুলনামূলকভাবে অধিকতর লাভজনক। এক্ষেত্রে কম পুঁজিতে বেশি মুনাফা পাওয়া যায় এবং এর পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ও ব্যাখ্যা রয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে, কৃষির মাধ্যমেই পৃথিবীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা ঘটে। সুতরাং, প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতবর্ষে কৃষি মানুষের জীবিকার উৎস। শত শত বছর ধরে এ উপমহাদেশে শাসক পরিবর্তিত হয়েছে, তথাপি কৃষিকাজের পরিবর্তন ঘটেনি। আর শহরের চেয়ে গ্রামে স্বাভাবিকভাবে জমি-জমা বেশি থাকাতে গ্রামের মানুষ মূলত কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিলো। শহর থেকে ২/১ টা জিনিস বাদে প্রয়োজনীয় বাকী সব জিনিস মানুষ গ্রামেই তৈরি করতো। অর্থাৎ প্রাক বৃটিশ এবং তার অনেক আগে থেকে গ্রামগুলো ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এই পূর্ণতা অর্জিত হয়েছিলো কৃষির মাধ্যমে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের অস্তিত্ব ছিলো বলে স্যার চার্লস ম্যাটকেফে উল্লেখ করেন। তার এই দাবীকে স্যার হেনরী মেইন, কার্ল মার্ক্স, মহাত্মা গান্ধীও সমর্থন যোগান। গ্রামের মানুষের জীবন যে ওতোপ্রোতোভাবে কৃষির সাথে জড়িত ছিলো তার বর্ণনা দিতে গিয়ে ম্যাটকেফে বলেন, “সাম্রাজ্য ভাঙ্গে সাম্রাজ্য গড়ে, যুদ্ধ বাঁধে যুদ্ধ শেষ হয়, রাজা যায় রাজা আসে, কিন্তু গ্রামীণ সম্প্রদায় একই থেকে যায়।” এতে বুঝা যায়, রাজা-রাজড়া নিয়ে কৃষকের কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না। তারা আপন মনে চাষ করে যেতো। যুদ্ধ লাগলে হয়তো কিছু দিনের জন্য তা বন্ধ রাখতো, তবে যুদ্ধ শেষ হলে আবারও তারা পূর্বের কাজে মনোনিবেশ করতো। আর তাই কৃষকের ছেলে কৃষকই হতো। বংশ পরম্পরায় এভাবে চলে এসেছে বহু বছর। অন্যদিকে, ব্রিটিশ শাসনামলের গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে ইংরেজরা নীল চাষে উৎসাহী হয়ে পড়ে। ফলে কৃষির ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে আরও অধিক পরিমাণে শস্য উৎপাদন করা সম্ভবপর হয়।
দেখা যায়, ১৯২১ সালে মোট জনগোষ্ঠীর ৭৭.৩% কৃষি নির্ভর ছিলো। কিন্তু দিনে দিনে এদেশে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে সবার চাহিদা পূরণ করা অসম্ভব হয়ে উঠে। তারপর বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সবুজ বিপ্লব ঘটলে ব্যাপক হারে কৃষি পণ্য উৎপাদিত হয় বলে অনেকাংশে এসব চাহিদা মেটানো গেছে। তবে যেহেতু এদেশে জ্যামিতিক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সেহেতু বাংলাদেশ কৃষিতে পুরোপুরি স্বনির্ভর হতে পারেনি। বিশ্ব ব্যংকের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে এদেশে ৭০.৬৩% কৃষি ভূমি ছিলো (বর্তমানে সামান্য কম হবে)। ৭০% লোক প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মোট জিডিপি-র ২২% আসে কৃষি খাত থেকে। ২০১৮ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, কৃষি থেকে মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬% যোগান আসে এবং জিডিপি-তে এর অবদান ১৪.১০ শতাংশ। এ বছর জানুয়ারি মাসে কৃষি শ্রমশক্তির শতকরা ১৩.৬ ভাগ জিডিপি-তে অবদান রেখেছে বলে জানা যায়। এভাবে যুগে যুগে, কালে কালে এদেশের মানুষ কৃষিকেই তার জীবনের অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করে এসেছে। কারণ, আমাদের দেশের মাটি যথেষ্ট উর্বর এবং প্রাকৃতিকভাবেই চাষোপযোগী। আর তাই এখানে আজও সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে বিধায় এদেশ এখনো সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামলা। তাছাড়া নদীমাতৃক বাংলাদেশে অন্য অনেক দেশের তুলনায় অধিকতর বৃষ্টিপাত হয়, যা চাষাবাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নদীর চরে পলি পড়ে, যা মাটি হিসাবে সবচেয়ে উর্বর; জলাশয় থাকায় সেচের সুবিধা রয়েছে। পাহাড়-টিলা দ্বারা পরিবেষ্টিত হওয়ায় এদেশে বৃষ্টি বেশী হওয়ার অন্যতম কারণ, যা বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে নির্দেশ করে। এদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ, যে কারণে সারা বছর কৃষি কাজ/চাষাবাদ করার জন্য যথার্থ (উল্লেখ্য- শস্য উৎপাদন, পশুপালন, মৎস চাষ, মৌমাছি চাষ, রেশম পোকা চাষ ইত্যাদি কৃষির অন্তর্ভুক্ত)। এজন্য কৃষিকে জীবন ধারণের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করা লাভজনক এবং সহজতর। পাশাপাশি দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো যাবে। কাঁচামালের সহজলভ্যতার জন্য কম পুঁজিতে ব্যবসা করা সম্ভবপর, যা দরিদ্র ব্যক্তির জন্য সুবিধাজনক। সরকারও তাই উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনে সহজ কিস্তিতে, অল্প সুদে, কম পরিমাণে টাকা ঋণ দিতে উদ্যোগ নিয়েছে। একারণে শিক্ষিত ব্যক্তি এ কাজে এগিয়ে আসলে কৃষিতে আরও সুফল ভোগ করা যাবে। এবং শিক্ষিত বেকারদের কথা চিন্তা করেও সরকার এরূপ সুবিধা দিয়েছে। তবে ব্যবসা যেহেতু লাভের পাশাপাশি ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যায় সেই হেতু এ বিষয়টাকে মাথায় রেখেই এগুতে হবে।
সর্বোপরি, সোনালী আঁশের এদেশ গোলা ভরা সোনালী ধান, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছেই সুন্দর, সাবলীল, স্বনির্ভর এবং পরিপূর্ণ। সেই পূর্ণতাকে আমাদের আবারও ফিরিয়ে আনতে হবে।
লেখক:প্রোগ্রাম অফিসার, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেল, সুনামগঞ্জ।