অনলাইন ডেক্স::
‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’ প্রতিপাদ্য নিয়ে শুরু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা। সকাল ৯টায় চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এবং ঢাবির উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন।
নতুন বছরের রঙ ছড়ানো পহেলা বৈশাখকে বাঙালি বরণ করে নেয় নানা অনুষঙ্গে। এরই একটি হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। রাজধানীতে ১৯৮৯ সালে শুরু হওয়া সেই শোভাযাত্রায় প্রতিবছর মিলে যায় সব বয়সের ও সব ধর্ম বর্ণের নানা পেশার মানুষ। ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টিকারী অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার পেয়েছে জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, তাই এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান সেজেছে আরও রঙিন ও ভিন্ন আবহে।
১৯৮৯ সালে চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে ঢাকায় এইদিনে প্রথমবারের মতো বের করা হয়েছিল এই শোভাযাত্রা।পরে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সর্বশেষ গত বছরের ৩০ নভেম্বর এই শোভাযাত্রাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। সেই হিসেবে স্বীকৃতি লাভের পর এবারই প্রথম নববর্ষ।
জানা যায়, মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রথম শুরু যশোরের ‘চারুপীঠ’ নামের এক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে। সেই যাত্রায় যশোরবাসী টানা দুই-আড়াই ঘণ্টা দল বেঁধে নেচে গেয়ে ছুটে বেড়িয়েছিল। এরপর প্রতিবছর একই আনন্দ যাত্রা। সেই আনন্দ শোভাযাত্রার জোয়ার যশোর ছাড়িয়ে চলে এলো ঢাকায়। তিন বছর পর একই উদ্দেশ্যে, একই ঢংয়ে, একই নামে শোভাযাত্রা শুরু হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে।
১৯৮৯ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজন করছে আনন্দ যাত্রা। প্রতি বছরের প্রথম দিন ফেলে আসা বছরের সব গ্লানিকে মুছে ফেলার প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয় দিনটি। ব্যর্থতা আর হতাশা, সব বিভেদকে দূর করার দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে স্বাগত জানায় বাঙালি। দশম বছরে (১৯৯৬) এই আনন্দ শোভাযাত্রাটির নাম হয়ে যায় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’।
জানা যায়, ইতোপূর্বে ইউনেস্কোর ‘ইনটেনজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তালিকায় বাংলাদেশের কারুশিল্প জামদানি এবং বাউল গানও স্থান পায়। এছাড়াও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় বাগেরহাটের ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর’, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের নাম রয়েছে। এছাড়া গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকেই আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ইউনেস্কো আবেদন করেছিল কিন্তু সেগুলো গৃহীত হয়নি।
পরে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর জাতিসংঘের এই সংস্থা ইউনেস্কো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় শেষ হওয়া ইউনেসকোর ‘স্পর্শাতীত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবিষয়ক আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিটির (ইন্টার গভর্নমেন্টাল কমিটি অন ইনট্যানজিবল হেরিটেজ) ১১তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
স্বীকৃতির বিষয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস বলেন, ‘যতদিন ধরে শোভাযাত্রাটি হচ্ছে ততদিন ধরেই একটি মহল সমালোচনা ও কটূক্তি করে আসছে। ফলে এই স্বীকৃতি তাদের সেই সংকীর্ণ বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাড়িত যে বিবেচনাবোধ, যে সমালোচনা, তাদের বিরুদ্ধে এটি একটি বড় জবাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশের এই মঙ্গল শোভাযাত্রা আজ সর্বজনীনভাবে পালিত হবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সম্ভব হলে তারাও অনুসরণ করবে। যেভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’
ইউনেস্কোর এ ঘোষণা বাঙালি সংস্কৃতির আরেকটি মাইলফলক উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন,‘বৈশাখী উৎসব বাঙালির হাজার বছরের শাশ্বত উৎসব। হাজার বছর ধরে এ উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এটা মানুষের অসাম্প্রদায়িক এক উৎসব। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাংলাদেশিসহ বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনা করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রার তাৎপর্য অনেক গভীরে। এটা যেমন আমাদের সংস্কৃতির শাশ্বত রূপ তেমনি মানুষের স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করারও একটি পথ।’
এ বছরের মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন বিষয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা উপ-কমিটির আহ্বায়ক ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. নিসার হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘অন্যসব বছরের চেয়ে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা কিছুটা ব্যতিক্রম। এর অন্যতম কারণই হলো ইউনেস্কোর স্বীকৃতি।’
এবারের শোভাযাত্রার বিশেষত্ব কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবারের শোভাযাত্রা হবে অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সুতরাং জঙ্গিবাদের সঙ্গে যারা যুক্ত হচ্ছেন, তাদের শুভবুদ্ধির উদয়ের আহ্বান জানানো হচ্ছে এ আয়োজনে। এছাড়া এবার শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য- ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।’