বিশেষ প্রতিনিধি::
গত ১৭ মার্চ সাম্প্রদায়িক হামলায় তছনছ সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াগাঁও। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের অনুসারীরা ভাংচুর লুটপাটের পাশাপাশি হতদরিদ্র দুটি পরিবারের বাদ্যযন্ত্রও গুড়িয়ে দিয়ে গেছে। গুড়ানো বাদ্যযন্ত্র দেখে র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ১৮ মার্চ গ্রাম পরিদর্শনে এসে। গানের উপকরণ গুড়িয়ে দেওয়া লোকদের তিনি ‘অমানুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। অসুরদের হাতে গুড়ানো বাদ্যযন্ত্র হারা সেই গ্রামের বাসিন্দা মনমোহন দাস একজন শ্রমজীবী মানুষ। সৌখিন শিল্পীও। সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে সন্ধ্যায় পরিবারের লোকজনসহ পাড়ার লোকদের নিয়ে মনের সুখে গান করেন। নৈমিত্তিক ব্যথা, যাতনা সুরে সুরে ওড়িয়ে দেন। সঙ্গীতযন্ত্র হারিয়ে তিনি খুবই মর্মাহত হন। তার মতো একই পাড়ার দশম শ্রেণির ছাত্রী এতিম কন্যা শ্রাবন্তী দাসের বাদ্যযন্ত্রও গুড়িয়ে দিয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা। তার মনও বেজায় খারাপ। তাদের এই অবস্থা প্রত্যক্ষ করে দুটি পরিবারকে বাদ্যযন্ত্র উপহার দিয়েছে ইস্টহ্যান্ডস নামক একটি মানবিক সংগঠন। সেই যন্ত্র পেয়ে এখন আবারও সুর তুলছেন মন মোহন দাস ও শ্রাবন্তী দাস। বেদনাভরা কণ্ঠে তারা প্রাণ খুলে গাইছেন মানুষের মিলনের গান। গত ৭ এপ্রিল তাদের হাতে এই বাদ্যযন্ত্রগুলো তুলে দেয়া হয়।
তারা গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা প্রার্থনার ভাষায় গাইছেন লালনের ‘ভবে মানব-গুরু নিষ্ঠা যার/সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার।, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে।’/ বাউল মহাজন শাহ আবদুল করিমের ‘তুমিও মানুষ আমিও মানুষ, সকল এক মায়ের সন্তান/ এসব নিয়ে দ্বন্ধ কেন, কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান’। তাছাড়া কীর্তনের বিরহের সুরেও তারা মানবতার গান গাইছেন। অসুর বিনাশের আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের গান শুনতে আসছেন পাড়ার লোকজনও।
শান্তি-সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক রাজধানী খ্যাত সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির রোলমডেল সুনামগঞ্জের প্রথম মন্ত্রী বাবু অক্ষয় কুমার দাস, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, একুশে পদকপ্রাপ্ত বাউল মহাজন শাহ আবদুল করিম, রামকানাই দাস, সুহাসিনী দাসসহ অসংখ্য ব্যক্তিদের পদচারণায় সম্প্রীতির রসে ভেজা এই হাওর-ভাটির মাটি। কিন্তু গত ১৭ মার্চ হেফাজত নেতা মামুনুল হকের নিয়ে ফেইসবুকে করা পোস্টকে কেন্দ্র করে তার হাজারো অনুসারী হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম নোয়াগাঁওয়ে হামলা ও লুটপাট করে এলাকার সম্প্রীতি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। গুড়িয়ে দিয়েছে মন্দির ও মূর্তি। গরিব গ্রামবাসীর সাংসারিক উপকরণ তছনছ করার পাশাপাশি শিশুদের বইপত্র ছিড়ে নষ্ট করে দিয়েছিল তারা। কয়েকটি পরিবারের গানের বাদ্যযন্ত্রগুলো নষ্ট করে দিয়েছিল। যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেখানে ফের বাদ্যযন্ত্র কেনা তাদের কাছে দুঃস্বপ্ন ছিল। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুড়ানো বাদ্যযন্ত্র দেখে যুক্তরাজ্য থেকে ইস্টহ্যান্ডের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী আ স ম মাসুম দুটি পরিবারের সঙ্গীতযন্ত্র কিনে দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। যন্ত্রের পাশাপাশি সংগঠনের পক্ষ থেকে তারা গ্রামে দুটি নলকুপও স্থাপন করে দিয়েছে। দুটি পাড়ার অর্ধশত মানুষ এখন সেই নলকুপের বিশুদ্ধ পানি করার সুযোগ পাচ্ছে। তবে সৌখিন গায়েন মনমোহন দাস ও শ্রাবন্তী দাসের গানের জলসায় সুখ খুজছেন মানসিকভাবে বিধ্বস্থ গ্রামবাসী।
মনমোহন দাস কাজ শেষে রাতে বাড়ি ফিরে হারমোনিয়াম নিয়ে বসেন। তার সন্তানরা খোল, করতালসহ অন্যান্য লোকজ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে তাকে সহযোগিতা করেন। কিন্তু ১৭ মার্চ হামলাকারীরা তার ঘরদোর ভেঙ্গে দেওয়ার পাশাপাশি এই বাদ্যযন্ত্রগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি এই বাদ্যযন্ত্র আবার কিভাবে জোগার করবেন এই চিন্তায় অস্থির ছিলেন। তাকে অবাক করে দিয়ে ইস্টহ্যান্ডস হারমোনিয়াম, তবলা, খোল-করতাল উপহার দিয়েছে। এমন উপহার পেয়ে বিষ্মিত তিনি। জলভরা চোখে কেবল কৃতজ্ঞতা জানালেন।
মনমোহন বলেন, ‘আমি হারমোনিয়াম দিয়া সব সময় গান গাই। আমার হারমোনিয়ামটি তারা ভেঙ্গে দিছিল। এখন নতুন হারমোনিয়াম-খোলসহ বাদ্যযন্ত্র পেয়ে আমি খুব খুশি। কোটি টাকা পেলেও আমি এমন খুশি হতামনা। এগুলো পেয়ে প্রথম দিনই পাড়ার মানুষদের জড়ো করে লালনের মানবমিলনের গান গাইতেছি। করিম মহাজনের গান গাই। আমরা পিছনের বিষাদ ভুলে যেতে চাই। সবাইকে নিয়ে ভালোভাবে বাঁচতে চাই। চোখের জল লুকিয়ে মুছে তিনি বলেন, ‘এই বাদ্যযন্ত্রগুলো আমরা স্মৃতিতে মমি করে রাখব’।
একই পাড়ার মৃত রন্টু দাসের মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী শ্রাবণী দাস। সাধ্য নেই তার একটি হারমোনিয়াম কেনার। মা অনেক কষ্টে একটি খোল কিনে দিয়েছিলেন। সেই খোলেই মগ্ন থাকতো সে। তার খোলটিও অসুররা ভেঙ্গে দিয়ে গিয়েছিল। তাকেও একটি উন্নত খোল উপহার দিয়েছে ইস্টহ্যান্ডস। উপহার পেয়ে বিষ্মিত শ্রাবণীও। শ্রাবণী বলেন, ‘আমার মা অনেক কষ্ট করে আমাকে খোলটি কিনে দিয়েছিলেন। সেটিও তারা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। আমার মন খারাপ ছিল এ ঘটনায়। কারণ এটি আমার খুবই একটি প্রিয় যন্ত্র ছিল। এর বদলে নতুন ও উন্নত একটি খোল পেয়ে আমি খুবই আনন্দিত।
গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল দাস বলেন, সংগঠনটি আমার গ্রামের দুটি পরিবারকে সঙ্গীতের বাদ্যযন্ত্র ও দুটি নলকুপ দিয়েছে। এই টিউবওয়েল পেয়ে তারা খুবই খুশি। টিউবওয়েল দুটিতে বেশ কয়েকটি পরিবারের মানুষজন বিশুদ্ধ জল খাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
ইস্টহ্যান্ডসের চেয়ারম্যান নবাব উদ্দিন বলেন, মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য যুক্তরাজ্যে, বাংলাদেশ ও আফ্রিকায় কাজ করে যাচ্ছে ইস্টহ্যান্ডস। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো-মানবতার জন্য কাজ করা। শাল্লায় যে ঘটনা ঘটেছে সেটি আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করেছে। মানুষের মনের ক্ষতি কখনো পোষাবার নয়। তবে আমরা তাদের জীবনের প্রয়োজনে দুটি নলকুপ ও দুটি পরিবারকে বাদ্যযন্ত্র কিনে দিয়েছি। আগামীতেও আমরা মানুষের পাশে মানুষের আনন্দে এভাবে কাজ করে যাব।