1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৪৬ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

ধানের সাগর শনির হাওর: উৎপাদিত হবে ২শ কোটি টাকার ফসল।। শামস শামীম

  • আপডেট টাইম :: শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২১, ১১.১৭ পিএম
  • ৩৭৪ বার পড়া হয়েছে

সূর্য ও ছায়ার ছেলে শনি। তেজে বলিয়ান এক তপস্বী। স্ত্রী ঋতু¯œান শেষে স্বামীসঙ্গ পেতে উদগ্রীব। কিন্তু ধ্যানমগ্ন শনি ফিরেও থাকাননা চিত্ররথের সুন্দরী কন্যার দিকে। ক্ষুব্দ স্ত্রী শাপ দেন শনি যার দিকে থাকাবেন তিনি বিনষ্ট হবেন। তাই-ই হয়। এই শনি কালিকাপুরাণ, সাম্ব পুরাণ, অগ্নিপুরাণে একই আবহে নানারঙে চিত্রিত হয়েছেন। সুনামগঞ্জের ধানের সাগর খ্যাত ‘শনির হাওর’ও সোনার ধান নিয়ে খেয়ালি প্রকৃতির কাছে মাঝে মধ্যে হেরে যায়। শনির বিরূপ দৃষ্টি যেন পড়ে হাওরে। তখন হাওরবাসী হাহাকার করে। কিন্তু এবার মওসুম ভালো থাকায় কাঙ্খিত ফলন হয়েছে হাওরে। হলুদরঙা ধানের সাগরে রূপ নিয়েছে শনি। সেখানে উদয়াস্ত কাস্তে, ওকন, ঠুকরি-বস্তা হাতে ব্যস্ত লাখো কিষাণ-কিষাণী। শ্রমিক নিয়ে হাওরে ব্যস্ত কৃষক। তাদের স্ত্রী কন্যারা ব্যস্ত ধানখলায় ধান শুকানো ও গোলায় তোলা নিয়ে মগ্ন।
তিনটি উপজেলা নিয়ে বিস্তার শনির হাওরের। জমির পরিমাণ বেশি হওয়ায় এটি তাহিরপুর উপজেলার হাওর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তবে বিশ্বম্ভরপুর ও জামালগঞ্জ উপজেলায়ও এই হাওরের বেশ কিছু জমি রয়েছে। হাওরের চারদিকে এখন বিস্তৃত ধানক্ষেতে হাউয়ার ঢেউ। দৃষ্টির চত্বরে কেবলই ধান আর ধান। কখনো কখনো কালবৈশাখির চোখরাঙানি আর শিলার রূপ দেখে বিচলিত হচ্ছেন কৃষক। হাওর ঘেঁষা মেঘালয় থেকে নেমে আসা আগ্রাসী ঢলের কম্পনও কানে শীষ কেটে ভয় দেখাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই নোনাঘাম ঝরানো একমাত্র ফসল গোলায় তোলতে এখন লাখো কৃষক অস্তির সময় পার করছেন হাওরে। জেলা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও বংশ পরম্পরায়ও মওসুমি শ্রমিকরা ধান কাটতে এসেছেন হাওরে। ধান কেটে তারা বছরের খোরাক সংগ্রহ করে ফিরবেন বাড়ি। কৃষক ও শ্রমিকের মুখ হাসি হাসি করবে।
সুনামগঞ্জ কৃষি বিভাগের মতে শনির হাওরে আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৩০ হেক্টর জমি। হাইব্রীড, উফশি ও স্থানীয় জাতের ধানও চাষ করেছেন কৃষক। কৃষি বিভাগের মতে এই শনির হাওরে উৎপাদিত ধানের মূল্য প্রায় ২শ কোটি টাকা। তাহিরপুরে শনির হাওরে ৬ হাজার, বিশ্বম্ভরপুরে ১ হাজার ৩০০ এবং জামালগঞ্জে ৬৪০ হেক্টর জমি রয়েছে। এছাড়া এই হাওরে সব মিলিয়ে আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৩০ হেক্টর বোরো জমি। গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি প্রায় ৪.০২ মে.টন চাল।
সোমবার দুপুরে তাহিরপুর এলাকার শনির হাওরের ভিতরে প্রবেশ করে দেখা যায় দলে দলে ধান কাটছে শ্রমিকরা। কৃষক জাঙ্গালে দাড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন এবং কাজেও সহযোগিতা করছেন। হাওরের উত্তর দক্ষিণ মুখি (ধান পরিবহন-চাষাবাদ করার সময়ে ব্যবহারের একমাত্র রাস্তা) কয়েকটি গোপাট ঘুরে দেখা গেছে চারদিকেই বিস্তৃত পাকা ধান ক্ষেত। সবদিকেই ধান কাটছে হাজারো শ্রমিক। কেউ খোলা গলায় গান গেয়ে ধান কাটছেন। কেউবা মোবাইল ফোনে গান বাজিয়ে গানের তালে মনোনিবেশ করে ধান কাটছেন। অন্যের থাকানোর সময় নেই। আসন্ন বিপদের কথা আঁচ করতে পেরে সবাই ধান কাটায় বিভোর। কাটা ধান অটো রিক্সা ও গরু, মহিষের গাড়ি দিয়েও খলায় ধান আনছেন কৃষক ও তাদের সন্তানরা। জাঙ্গালে খলায় খড় শুকাচ্ছেন গবাদি পশুকে খাওয়াতে। প্রতিটি গোপাটেও ভিড়। উজান তারিপুরের দক্ষিণমুখি গোপাট দিয়ে প্রবেশ করে জামালগঞ্জের বেহেলি মুখি গোপাটে গিয়ে দেখা যায় সেই এলাকায়ও কাজ করছেন কৃষক। বিশাল হাওরের কোন কুলকিনারা দেখা যাচ্ছেনা। শুধুই বিস্তৃত ধান ক্ষেত। ঘুরে ঘুরে ভাটি তাহিরপুরের উত্তরমুখি গোপাট দিয়ে প্রবেশ করে দেখা গেল খলায় শত শত কিষাণ-কিষাণী সন্তান সন্ততি নিয়ে কাজ করছেন।
মধ্য তাহিরপুর গ্রামের কৃষক আয়ূব আলী (৫৫) এ বছর প্রায় ৬ একর জমিতে ধান লাগিয়েছেন। এখন ধান কাটছেন শ্রমিকরা। গত ৫ বছর ধরে তার ক্ষেতের ধান কেটে দিতে আসছেন একই উপজেলার বিন্নাকুলির শ্রমিকরা। গোপাটে দাড়িয়ে তিনি শ্রমিকদের নির্দেশনার সঙ্গে ধানির মুঠি টানার কাজও করছেন।
শ্রমিক আব্দুর রাজ্জাক গত ৪০ বছর ধরে শনির হাওরে ধান কাটছেন। তাকে তার পিতা এই হাওরে কিশোর বয়সে ধান কাটতে নিয়ে এসেছিলেন। এখন তিনিও তার ছেলে ফসিউল আলমকে ধান কাটতে নিয়ে এসেছেন। গত ১০ বছর ধরে বাবার সঙ্গে হাওরে ধান কাটতে আসছেন ফসিউল। একই এলাকার শ্রমিক নূর আলমও গত ২০ বছর ধরে ধান কাটতে আসছেন শনির হাওরে। তার সঙ্গে এখন তার ছেলে নজরুল ইসলামও ধান কাটতে এসেছে। পাশেই আরেকটি ক্ষেতে তাহিরপুর উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ শ্রমিক মধু মিয়া হাওরে ধান কাটতে এসেছেন। ধান কাটায় এখন সঙ্গে নিয়ে এসেছেন ছেলে আজিজুল হককে। তিনিও পিতার হাত ধরে ৩০ বছর আগে এভাবে ধান কাটতে এসেছিলেন। শ্রমিকরা জানালেন, মওসুম ভালো হলে হাওরে ধান কাটতে পারলে অন্তত ৬ মাসের খোরাকি সংগ্রহ করেন তারা। তখন নিশ্চিন্তে বসে ঘরের ভাত খেতে পারেন। শ্রমিকরা জানালেন, ৭ হিস্যায় ধান কাটেন তারা। ৬ ঠুকরি ধান মালিকের হিসেবে ফেলে এক ঠুকরি ধান তাদের ভাগে ফেলা হয়। প্রতিদিন প্রায় এক মনের কাছাকাছি ভাগে ধান ভাগে পাওয়া যায়। দশ দিনের মধ্যেই শেষ হবে এই হাওরের ধান কাটা।
শ্রমিক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাপে হাতে ধইরা ৪০ বছর আগে ধান কাটায় নিয়া আইছিল। অনে আমিও আমার পুতরে লইয়া ধান কাটতে আইছি। ঠিক মতো ধান কাটতে পারলে ৬ মাস ঘরো বইয়া খাওন যাইব।’
শ্রমিক নূর আলম বলেন, ‘বৈশাখও দিন মাদান বালা থাকেনা। যে কোন সময় তুফান টাটা (বজ্রপাত) আইতে পারে। এতে আউরো ধান কাটার শ্রমিকরা মারা যায়। তার বাদেও পেটের জ্বালায় আমরা আসি। সরকার যদি টাটা বন্ধে কোন ব্যবস্থা নিতো তাইলে শ্রমিকরাও বাঁচতো। কৃষকরাও ধান কাটা নিয়ে চিন্তায় থাকতোনা।
জমির মালিক আয়ূব আলী বলেন, ‘শনির আওর আমরার আশির্বাদ এবং অভিশাপেরও নাম। তবে গত দুই বছর ধইরা আশির্বাদ দিছে শনি। আওর ভইরা ধান দিছে। হেই ধান তোলতাম পারছি। ইবারও দিন মাদান বালা থাকায় মনে অয় সব ধান তুলতাম পারমু। তিনি বলেন, ‘ই ধানের উফরেই আমরার বাইচ্চা থাকা, বিয়ে সাদি-লেখাপড়া আর জীবন ধারনের সব খরচ করি। ধান মাইর গেলে আমরার কান্না কেউ দেখার নাই।’
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ফরিদুল হাসান বলেন, মওসুমে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় ফলন কিছুটা কম হলেও কাঙ্খিত উৎপাদন হয়েছে। আমাদের গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি প্রায় ৪.০২ মে.টন চাল। তিনি বলেন, শনির হাওর জেলার অন্যতম বড় হাওর। তিনটি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত এই হাওরে এবার ধান ভালো হয়েছে। অর্ধেকের কাছাকাছি ধান ইতোমধ্যে কাটা হয়ে গেছে। এই মাসের মধ্যেই প্রায় সব ধান কাটা শেষ হবে।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!