হাওর ডেস্ক::
স্ত্রীর প্রতি কুনজর ছিল জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানের। বিষয়টি জানার পর ইমামকে নিষেধ করতে মসজিদে গিয়েছিলেন স্বামী আজহার। সেখানে বাগবিতণ্ডার এক পর্যায়ে ধারালো ছুরি দিয়ে আজহারের গলায় আঘাত করেন ইমাম। এভাবে হত্যার পর মরদেহ ছয় টুকরা করে মসজিদের সেপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে রাখেন ওই ইমাম।
ঘটনাটি ঘটেছে রাজধানীর দক্ষিণখানে সরদারবাড়ি জামে মসজিদে। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে ওই মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয় ছয় টুকরা লাশ। গ্রেপ্তার করা হয় অভিযুক্ত মাওলানা আব্দুর রহমানকে। জব্দ করা হয় হত্যায় ব্যবহৃত পশু জবাই করার তিনটি চাকু। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রীকেও আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে গতকাল দুপুরে ওই মসজিদের সামনে গিয়ে স্থানীয় মুসল্লি ও অন্যদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। এ সময় কয়েকজন মুসল্লি বলেন, ‘মাওলানা আব্দুর রহমান ৩৩ বছর ধরে এই মসজিদে ইমামতি করছেন। প্রতি ওয়াক্তে আমরা এই হুজুরের পেছনে নামাজ পড়ি। এখন শুনছি অন্যের স্ত্রীর প্রতি কুনজর দেওয়ার জের ধরে হুজুর একজনকে খুন করে লাশ ছয় টুকরা করে মসজিদের ওজুখানার ট্যাংকের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বিষয়টি ভাবতে গিয়েও গা শিউরে উঠছে।’
বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্ত্রীর ওপর ইমামের কুনজর পড়ার অভিযোগ পেয়ে গত ১৯ মে রাতে সরদারবাড়ি জামে মসজিদে ইমামের কক্ষে যাওয়ার পর থেকেই আজহার নিখোঁজ ছিলেন। পরিবারের অভিযোগের ভিত্তিতে এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এক পর্যায়ে মসজিদের সিঁড়িতে রক্তের দাগ ও সেপটিক ট্যাংক থেকে দুর্গন্ধ বের হওয়ার তথ্য পায় র্যাব। গতকাল ভোরে ইমামকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যার ঘটনা বেরিয়ে আসে।
গতকাল দুপুরের দিকে এলাকায় গেলে সরদারবাড়ি জামে মসজিদের সামনে স্থানীয় মুসল্লিসহ এলাকাবাসীর ভিড় দেখা যায়। দোতলা ভবনবিশিষ্ট মসজিদের এক পাশ তালাবদ্ধ। অন্য পাশ নামাজের জন্য খোলা। নিচতলার ওজুখানার পানির ট্যাংকের ভেতর থেকেই আজহারের ছয় টুকরো লাশ উদ্ধার করা হয়। সেখানে উপস্থিত মো. মোস্তফা নামের এক মুরব্বি বলেন, সকালে দুর্গন্ধ পাওয়া যায় মসজিদে। এ নিয়ে কানাকানি শুরু হয়। এক পর্যায়ে তা জেনে পুলিশ ও র্যাব এসে ছয় টুকরা লাশ উদ্ধার করে। পরে হুজুরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় র্যাব। রিফাত নামের আরেক মুসল্লি বলেন, ‘ঠিক কখন আজহারকে খুন করা হয় তা আমরা জানি না। তবে হত্যার পর লাশ মসজিদের ভেতরে রেখেই ইমাম সাহেব আমাদের নামাজ পড়ান বলে মনে হচ্ছে।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে গতকাল বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন র্যাব-১-এর পরিচালক (সিও) লে. কর্নেল আব্দুল মুত্তাকিম। তিনি বলেন, র্যাব হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে ইমাম আব্দুর রহমান আজহারকে হত্যার দায় স্বীকার করেন। ইমাম রহমান র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, আজহার অভিযোগ করছিলেন যে তাঁর স্ত্রীর দিকে ইমামের কুনজর রয়েছে। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডায় তিনি আজহারকে হত্যা করেন। তবে আজহারের স্ত্রীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করেন ইমাম।
আব্দুল মুত্তাকিম বলেন, প্রাথমিক তদন্তে র্যাব জানতে পেরেছে যে দক্ষিণখানের বাসিন্দা আজহারের স্ত্রীর প্রতি কুনজর ছিল ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানের। বিষয়টি জানার পর ইমামকে নিষেধ করতে মসজিদে গিয়েই খুন হন আজহার। ইমাম পুরো হত্যাকাণ্ডটি ঘটান মসজিদে তাঁর শয়নকক্ষে। এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরও ইমাম মসজিদে নিজ কক্ষেই অবস্থান করেন। তিনি নিয়মিত ওয়াক্তের নামাজে ইমামতিও করেন।
র্যাব বলে, ‘নিহত আজহারের ছেলে আরিয়ান ওই মসজিদের মক্তবে পড়ত। আজহারও এই ইমামের কাছে কোরআন শিখতেন। সেই সুবাদে তাঁদের মধ্যে একটি পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। ওই ঘটনার এক দিন আগে আজহারের স্ত্রী আছমা গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে চলে যান। কিছু সময় আগে নিহতের স্ত্রীকে আমাদের হেফাজতে নিয়েছি। হত্যাকাণ্ডে তাঁর কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, তা জানতে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পরে জানানো সম্ভব হবে।’
ধারালো অস্ত্রগুলো কিভাবে মসজিদে এলো, জানতে চাইলে আব্দুল মুত্তাকিম বলেন, তিনি (ইমাম) দীর্ঘদিন ধরে ওই মসজিদে চাকরি করতেন। কোরবানির সময় পশু জবাই করার জন্য তিনি এগুলো মসজিদে নিজের জিম্মায় রাখতেন। সেই অস্ত্র দিয়েই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
র্যাব-পুলিশ যা বলছে : আজহার হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ইমাম আব্দুর রহমানের সঙ্গে নিহতের স্ত্রীর পরকীয়া প্রেমের সম্পর্কের তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে র্যাব-পুলিশের সূত্র দাবি করেছে। সূত্র বলছে, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দক্ষিণখানের মধুবাগ এলাকায় ইউসুফ গাজীর ৩৯ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকতেন নিহত আজহার। বাসায় আসা-যাওয়ার সূত্র ধরেই ইমামের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তাঁর স্ত্রীর। অন্তত এক বছর ধরে এই সম্পর্ক চলছিল। আজহার বিষয়টি টের পেয়ে পাঁচ মাস আগে বাসাও বদল করেন। ২০ দিন আগেও ইমাম ও আজহারের স্ত্রীর সাক্ষাৎ হয়। বিষয়টি জানতে পেরে আজহার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে তাঁর নিজ বাড়ি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে চলে যান। এরপর কালিহাতী থেকে ইমামকে ফোন করে তাঁদের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি জানতে চাইলে ইমাম অস্বীকার করেন। ইমাম বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আজহারকে মসজিদে আসতে বলেন। সে অনুযায়ী ইমামের সঙ্গে দেখা করতে গত ১৯ মে দক্ষিণখানে সরদারবাড়ি মসজিদে আসার পর নিখোঁজ হন আজহার।
এ ঘটনা তদন্তের একপর্যায়ে দক্ষিণখানে মাদরাসাতুর রহমান আল আরাবিয়া থেকে আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সরদারবাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে আজহারের লাশ উদ্ধার করা হয়।
দক্ষিণখান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল হক মিয়া বলেন, এ ঘটনায় পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক বিষয়ে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।