আমাদের ছোটবেলা ছিলো খুব ইন্টারেস্টিং। নানা বাড়ি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলা সদর থেকে সিলেট আসা ছিলো বিরাট এডভেঞ্চারাস ঘটনা। সকাল বেলা নদীর ঘাট থেকে লঞ্চে উঠতে হতো, দুপুরের পর লঞ্চ থেকে নামা জয়কলস ঘাট। নদীর পাড়ে ভাতের ঘরগুলো, তাজা মাছ দিয়ে খেয়ে হেটে হেটে এসে দাঁড়ানো সুনামগঞ্জ সড়কে৷ তারপর অপেক্ষা, অপেক্ষা, অপেক্ষা। হঠাৎ কোন বাস, কাঠের বডির বাস আহসান মারা ফেরি পার হয়ে এলো সুনামগঞ্জ থেকে। সেই বাসে উঠে আবার ডাবর আবার লামাকাজি ফেরি পার হয়ে সন্ধ্যার মুখে সিলেট শহরে ঢোকা। ও হ্যাঁ, উপজেলা সদরে ডায়নোমা বলে গড়গড় আওয়াজ তোলা এক পদ্ধতিতে সন্ধ্যার পর দুতিন ঘন্টা ইলেকট্রিসিটি। ঐ এতোটুকুই।
আর যে সব উপজেলা যেমন শাল্লা, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর এগুলো ছিলো সরকারী কর্মচারীদের কাছে আতংক- পানিশমেন্ট ট্রান্সফার। বর্ষায় হাতে চালানো নৌকা আর বর্ষা শেষে হাঁটা। হাঁটা মানে সড়ক পথ না, বোরো ক্ষেত ধরে মাইলের পর মাইল চলতে থাকা।
তো, এসব বেশী নয়। তিন যুগ আগের ঘটনা। এখন নিজের গাড়ি নিয়ে নানাবাড়ি যাওয়া যায় সর্ব্বোচ্চ আড়াই ঘন্টায়। জামালগঞ্জ, তাহিরপুরের মতো ’দুর্গম’ জায়গায় গাড়ি নিয়ে সরাসরি- ঐ দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। উপজেলা সদর তো বটেই হাওরের প্রত্যন্ত গ্রামে চলে গেছে বিদ্যুৎ। কোন কোন উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়িত। হ্যাঁ, সমস্যা আছে এখনো৷ এখনো বহু গ্রামে শতভাগ বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিট্রেশন নিশ্চিত হয়নি। এরকম একটা গ্রামের পানি ও স্যানিট্রেশনের জন্য কয়েক মাস ধরে আমি দেনদরবার করছি প্রশাসনের সাথে। হতে হবে, এটা মানুষের অধিকার। না হলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত পৌঁছাবো দাবী নিয়ে। এগুলো মানুষের মৌলিক অধিকার৷
যে কথা বলছিলাম। বিভাগীয় শহর সিলেট থেকে জেলা শহর সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে এখন সময় লাগে দেড় ঘন্টা। কোন ফেরী নেই, রাস্তা চমৎকার। সুনামগঞ্জে টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট হচ্ছে, মেডিকেল কলেজে হয়ে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজও শুরু হয়ে গেছে, অবকাঠামোগত আরো বহু উন্নয়ন হতে যাচ্ছে।
এসবই সরকারের উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার অংশ। কেউ না থাকলেও হয়তো হতো, তবে বাস্তবতা হলো সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী জনাব এম এ মান্নান এই অঞ্চলের মানুষ। এইসব দৃশ্যমান উন্নয়নে তাঁর কোন ভূমিকা নেই, এমনি এমনিই সব হচ্ছে- এমন বলাটা বোধ হয় বাংলাদেশের বাস্তবতায় সত্য নয়।
অনেক কিছু ছিলোনা, অনেক কিছু হয়েছে, আরো অনেক কিছু হবে- এই যে স্বপ্ন দেখা, বড় স্বপ্ন দেখা তার ধারাবাহিকতায় হয়তো পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন ‘সুনামগঞ্জে বিমান বন্দর হবে’। এই হওয়া মানে আগামী অর্থ বছরেই হবে এমন না, আগামী ভবিষ্যতে হবে। আগামীর পৃথিবীতে একটা জেলা শহরে বিমান বন্দর হওয়া অসম্ভব কিছু না বরং আশাবাদী কল্পনা। এই কল্পনা দোষের কিছু না। পরিকল্পনা মন্ত্রীকে নিয়ে হাসি তামশা, ট্রোল করার কিছু নেই। সকল মানুষ বদ্ধ দৃষ্টির হবেনা, কেউ কেউ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে।
আমি তাঁর এলাকার ভোটার না, সরকারী সুবিধাভোগী ও নই। তবু একবার তাঁর সাথে আলাপের সুযোগ হয়েছিলো। ভীড় বাট্টার মধ্যে আলাপ নয়, একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে, অন্য সকলকে সরিয়ে দিয়ে। আমাকে তাঁর মিনিট পাঁচেক সময় দেয়ার কথা ছিলো, সেটা শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছিলো এক ঘন্টার উপরে। পুরো সময়টা আমরা কথা বলেছিলাম জেনোসাইড নিয়ে। বিলিভ মি, সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী দীর্ঘ সময় ধরে একা আমার সাথে আলাপ করে গেছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘটা জেনোসাইড ও এর পেছনের রাজনীতি নিয়ে।
মোটামুটি দীর্ঘ এই আলাপ সময়ে আমার কাছে তাঁকে একজন স্বপ্নচারী, ভিশনারী মানুষ মনে হয়েছে। এমন মানুষেরা বৃহৎ স্বপ্ন দেখেন, বৃহৎ স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য ছুটেন। স্থানীয় রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচ ও নোংরামী এঁদের আহত করে। দলের উচিত না এরকম ভিশনারী মানুষকে সংসদ সদস্য বানিয়ে স্থানীয় রাজনীতির প্যঁচগোছে ফেলে তাঁর সময় নষ্ট করানোর। এঁরা হবেন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী, রাষ্ট্রের বিশেষ প্রয়োজনে।
কিছু মানুষ বড় স্বপ্ন দেখার জন্য, বড় কাজ করার জন্য। এম এ মান্নানকে সেই মানুষদের একজন মনে হয়েছে। সমকালে এঁরা হাসিঠাট্টা, উপহাস, ট্রোলের শিকার হবেন- ভবিষ্যতে এঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে উপকার ভোগী হবে সকলেই।
(লেখকের ফেইসবুক থেকে)