আমি এক জরাজীর্ণ প্রাচীন ভবন। ডাকনাম ডাকবাংলা। বয়সের ভারে আমি জর্জরিত। আমার বর্তমান ভগ্ন চেহারা দেখে সবাই যদিও মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু একদা আমারও রূপ ছিল। যৌবনে আমিও ছিলাম লাবণ্যময়ী।
চোখ মেলেই আমি দেখি অদূরে নীল “আকাশে হেলান দিয়ে” পাহাড় ঘুমায়। আমার সম্মুখ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে প্রাণোচ্ছল এক তটিনী। আমার জন্মের পর থেকে কী বিপুল জলরাশি প্রবাহিত হয়েছে এই স্রোতস্বিনীর বুক দিয়ে- তার হিসাব কে রাখে!
আমার জন্মের দিনক্ষণ এখন আর আমার মনে নেই। শুনেছি, ১৮৯৭ সালের ১২ জুন বিকেল পৌনে পাঁচটায় যে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প (দ্য গ্রেট আর্থকোয়েক) হয়েছিল, তার কয়েক বছর পর আমার জন্ম। ১৯০৭ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের লাট (লেফটেন্যান্ট গভর্নর) Sir Lancelot Hare সাহেব পার্শ্ববর্তী রাজকীয় স্কুলের পরিদর্শন খাতায় আমার অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছিলেন।
উপরিউক্ত মহা-ভূমিকম্পে নির্মাণাধীন পাকা কাচারি ভবনটি ধ্বসে পড়েছিল। এরপর থেকে এই অঞ্চলে পাকা দালান নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়। তার পরিবর্তে প্রচলন ঘটে বিশেষ একধরণের নির্মাণশৈলীর, যাকে বলা হয় আসাম-টাইপ ভবন। কাচারি ভবন ও আমাকে ওই বিশেষ রীতিতে নির্মাণ করা হয়। আমরা দু’জন প্রায় সমবয়সী। এ শহরে আমাদের বয়সী কেউ এখন আর বেঁচে নেই। একজন ছিল, আমাদের চেয়েও কিছুটা প্রাচীন, সেই রাজকীয় হাইস্কুলের একটি ভবন। কিন্তু কয়েক বছর আগে এক হঠকারী সিদ্ধান্তে তাকে খুন করা হয়। তার দেহাবশেষের ক্ষুদ্র একটি চিহ্নও আর অবশিষ্ট নেই! বন্ধু হারানোর গভীর ক্ষত বুকে নিয়ে আজও আমি বেঁচে আছি! বয়সে আমাদের কিছু ছোটো- এমন আরেকজন আছে; অদূরেই। কিন্তু তার অবস্থা এতোটাই করুণ যে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। জরাজীর্ণ অসহায় ভবনটির সামনে ভুঁইফোঁড়ের মতো গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য কদর্য দোকানপাট। রাতের আঁধারে নাকি তার ঘুপচি-ঘাপচিতে ঘটে নানান অনাচার। শোনা যায়, এসবের পেছনে রয়েছে বিরাট অংকের আর্থিক লেনদেনের ব্যাপার-স্যাপার। অনেক বড়ো বড়ো কর্তাব্যক্তিরাও না কি ভাগবাটোয়ারার অংশ পান।
সুখদুখমাখা কতো স্মৃতি, কতো ঐতিহাসিক ঘটনা এখনও মনের কোণে প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে। আবার সময়-ধুলোর পুরো আস্তরণে অনেক কথা ঢাকা পড়ে গেছে। ছোট্ট মফস্বলের বাসিন্দা আমি। এমন একটি সময় ছিল, যখন ভিআইপি, ভি-ভিআইপি যে-ই আসুন না কেন, আমার কাছেই সবাইকে আসতে হতো, থাকতে হতো কিংবা বিশ্রাম নিতে হতো। কয়েকটি ঘটনার কথা সংক্ষেপে বলে যেতে চাই, কারণ কোনদিন আবার অন্য বন্ধুবান্ধবের মতো আমাকেও চলে যেতে হয়!
যেহেতু সরকার আমাকে তৈরি করেছে, তাই উচ্চপদস্থ, নিম্নপদস্থ সকল রাজ-কর্মকর্তাই আমার অতিথি হতেন। সোনামুখি জাহাজে চড়ে প্রদেশের লাট (চিফ কমিশনার) Sir Archdale Earle (১৯১২-১৮) অনেকবার এসেছেন। তাঁর পরের লাট (সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত গল্প ‘পাদটীকা’য় যার নাম নন্দ দুলাল বাজায় ঘণ্টা) অর্থাৎ এন. ডি. বিটসন বেল সাহেবও দলবলসহ আমার অতিথি হয়েছেন। কেবল রাজপুরুষগণই নন, ব্যতিক্রমও আছে। সেগুলোই বলতে চাচ্ছি।
১৯২৪ সাল। সুরমা উপত্যকার রাষ্ট্রীয় সম্মিলনীর ৬ষ্ঠ অধিবেশন বসে এই শহরে। তারিখ ২২ ও ২৩ আগস্ট। সভানেত্রী হিসেবে এলেন দেশনেত্রী, প্রখ্যাত বাগ্মী ও কবি, সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসনেত্রী শ্রীমতী সরোজিনী নাইডু। তাঁকে এক ঝলক দেখার জন্য নিস্তরঙ্গ মফস্বল লোকে লোকারণ্য। ওই সম্মেলনটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমেই মূলত সুরমা উপত্যকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে।
কলকাতা থেকে স্টিমারে করে প্রিয়দর্শিনী, বিদুষী সরোজিনী এসে নামলেন শরতের মেঘমুক্ত সুনীল আকাশতলে অবস্থিত এ শহরের স্টিমার-ঘাটে। সেখান থেকে তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য আগেই একটি ছোট্টো গাড়ি আনানো হয়েছিল জেলা সদর থেকে। দুইদিন তিনি ছিলেন আমার অতিথি হয়ে। কান পাতলে আজও যেন তাঁর রিনিঝিনি মধুকণ্ঠের ধ্বনি শুনতে পাই।
১৯৩২ সালে কুখ্যাত কানিংহাম সার্কুলার বাতিলের দাবিতে রাজকীয় হাইস্কুলের ছাত্ররা রাজপথে নেমে এলো। মিছিলটি আমার সামনে আসামাত্রই পুলিশবাহিনী হিংস্র পশুর মতো ছাত্রদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। রবি দাম নামের ক্লাস সিক্সের একটি ছেলেকে মাটিতে ফেলে কী নির্দয়ভাবে পিটিয়ে মাথা রক্তাক্ত করা হলো- ভাবতে আজও আমার গাঁ শিউরে ওঠে! ওই আন্দোলনের কারণে বহু ছাত্রকে স্কুল থেকে rusticate করা হলো। মফস্বলের ছাত্রদের এরূপ প্রবল প্রতিবাদী হওয়ার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণও ছিল। দ্বিতীয় দফা আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে নেতাজি সুভাষ বসু এখানে এসেছিলেন। তাঁর সফরটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এরকম এক তেজস্বী বিপ্লবীর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে রাজনৈতিক অঙ্গনে যেন জোয়ার এসেছিল। তাই দেখেছি, ১৯৩২ সালে এই মফস্বলের রাজপথ অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। নারীরা পর্যন্ত রাজপথে নেমে এসেছিল; পিকেটিং করে দলে দলে তাঁরা কারাবরণ করেছিল।
আসাম প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৪৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর দলীয় প্রচারণায় এখানে এলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। জনসভায় বক্তৃতা করে তিনি আমার কাছে এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিলেন।
১৯৪২ সালের কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন, ১৯৪৭ সালের পাকিস্তান আন্দোলন, দেশভাগ, নবীন পাকিস্তানে ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ইত্যাদি কতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী আমি।
১৯৫৬ সালে এক মহান নেতার পদস্পর্শে আমি ধন্য হলাম। দিনটির কথা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল ২৬ নভেম্বর। প্রথমবারের মতো তিনি এখানে এসে মহকুমায় তাঁর দলের শাখা প্রতিষ্ঠা করে দেন। সে-বার তিনি আমার অতিথি হিসেবে এখানে রাত্রিযাপন করেন। এরপর আরও একবার তিনি আমার এখানে রাত্রিযাপন করেছিলেন; ১৯৬৪ সালের ৩০ আগস্ট। তাঁর ডাকেই ঘটে ছিল বাঙালি জাতির মহা-জাগরণ। হ্যাঁ, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ রাতে এক বাঙালি ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে ১০/১২ জন পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আমার কাছে এসে অবস্থান গ্রহণ করে। পরের দিন সকালে মুক্তিকামী ছাত্রজনতা আমার চারপাশে অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। সংঘটিত হয় এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক প্রতিরোধ যুদ্ধ। দিনভর যুদ্ধে দখলদার বাহিনী পরাজিত হয়। কিন্তু যুদ্ধে শহিদ হন তিনজন।
এরপর আরও কতো ঘটনা। বহু রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হলো। পাশের স্রোতস্বিনীতে বইতে লাগল বিপুল জলরাশি। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন ঘটে চলল দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পালা। মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ককে নির্মমভাবে হত্যা করে সামরিক উর্দি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের খেলা শেষ হলো না। সেই সামরিক জান্তাদেরও আমি দেখেছি।
১৯৯৬ সালের ৮ জুন নির্বাচনি প্রচারণায় এসে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে আমার কাছে ঘণ্টা দু-এক বিশ্রাম নিয়েছিলেন এবং দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মতবিনিময় করেছিলেন। ১০/১২ জন ছাত্রকর্মী তখন আমার প্রশস্ত বারান্দায় জড়ো হয়ে প্রিয় নেত্রীকে এক নজর দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি মারছিল। নিরাপত্তা কর্মীরা এতে বিরক্ত হয়ে তাদেরকে সরিয়ে দিতে চাইলে শুরু হয় মৃদু ধ্বস্তাধস্তি। আর তা শুনেই নেত্রী দরজা খোলে বের হয়ে এলেন। দৃপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে কী হয়েছে?’
নিরাপত্তা রক্ষীরা বললো, ছাত্রলীগের কর্মীরা এখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। তিনি বললেন, “না, তা হতেই পারে না। কই তারা? ডাকো তাদের। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলবো।” কে একজন তাড়াতাড়ি একটি বেতের চেয়ার নিয়ে এলো। তিনি আমার বারান্দায় সেই চেয়ারে বসলেন, আর ছাত্রকর্মীরা তাঁকে ঘিরে মেঝেতে বসে পড়লো। নেত্রী আবেগ জড়িত কণ্ঠে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোরা তো আমার রাসেল!” বেশ কিছুক্ষণ তিনি তাদের সঙ্গে কথা বললেন। সে-আজ কতদিন আগের কথা! কিন্তু মনে হয়- এই তো সেদিন! এরকম বিরল ঘটনা আমার জীবনে আর দেখিনি।
আমার এই প্রশস্ত বারান্দা, আমার প্রতিটি কক্ষ, আমার এই প্রাঙ্গণ কতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। কিন্তু সময়ের নির্মম থাবার সঙ্গে সঙ্গে কিছু লোভী মানুষও আমাকে কম আঘাত করেনি। পাকিস্তান আমলে এক বড়কর্তা ঘোষণা করলেন, আমার মেঝের কাঠের প্ল্যাংকগুলো না কি নষ্ট হয়ে গেছে! তিনি আমার মেঝেকে নিলামে তুললেন। দুর্মুখোদের বলতে শুনি- সেই মহান কর্তাব্যক্তি না কি কৌশলে নিজের লোক দিয়ে নামমাত্র দামে কাঠগুলো কিনে নেন এবং কথিত সেই নষ্ট কাঠ দিয়ে তার নিজের অট্টালিকা নির্মাণ করেন!
সেই সময়ই আমার সামনের দৃষ্টিনন্দন রেলিংটিও অপসারণ করা হয়৷ ১৯২৪ সালের সরোজিনী নাইডুর ছবিতে প্রবেশপথের সেই সুদৃশ্য রেলিংটাকে দেখা যায়। ১৯৫৬ সালে আমার সামনে নেতাকর্মীসহ বঙ্গবন্ধুর একটি ছবি আছে। তাতেও আমার সেই রেলিংটা দেখতে পাওয়া যায়।
সম্প্রতি আরম্ভ হয়েছে আমার জীর্ণসংস্কার। ভাবলাম, এবার বুঝি ফিরে পাবো আমার আদি রূপ; হারানো যৌবন! যদিও বলা হচ্ছে, মূল কাঠামো অবিকল রেখে সংস্কার কাজ করা হবে, কিন্তু না-জানি আমার কপালে কী আছে! কারণ ইতোমধ্যেই প্রবেশপথের সিঁড়ির গঠন আমূল পালটে গেছে। আমার সেই অপূর্ব রেলিংটি পুনর্নির্মাণ না করে বরং সিঁড়িটি হয়ে গেছে অর্ধচন্দ্রাকার। কিন্তু আসাম-টাইপ নির্মাণশৈলীতে এরকম অর্ধচন্দ্রাকার বা বৃত্তাকার কাঠামোর কোনো অস্তিত্ব-ই ছিল না। তাছাড়া আমার প্রাঙ্গণের বয়সী একটি দুর্লভ সোনালু বৃক্ষ ও একটি সুন্দর কৃষ্ণচূড়াকে বলি দেওয়া হয়েছে। কয়েকবছর আগে আমার একপাশ ঘেঁষে নির্মিত হয়েছে একটি বেঢপ কমিউনিটি শৌচাগার।
এভাবে তিলে তিলে না মেরে আমাকে বরং পাশ্ববর্তী প্রবহমান তটিনীতে বিসর্জন দেওয়া হোক। তাতে আমি এই ভবযন্ত্রণা থেকে অন্তত মুক্তি পাবো। আর আমার জায়গায় নির্মিত হোক সুরম্য অট্টালিকা!