অনলাইন ডেক্স::
মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে পবিত্র মসজিদের সামনে রয়েছে নানা ধরনের নান্দনিক ভাস্কর্য্য। এসব ভাস্কর্য্যে ইসলামি ঐতিহ্য, জাতীয় ও ধর্মীয় বীর, কবি-সাহিত্যকসহ নানা গুণিজনকে তুলে ধরা হয়েছে।
বিশ্বঐতিহ্যে তুরস্কের সেলিমী মসজিদের খ্যাতি ইসলামী নকশার একটি অনবদ্য ‘মাষ্টারপিস’ হিসেবে। এর চোখ ধাঁধানো নকশা ও কারুকার্য আজও বিস্মিত করে বিশ্বের নানা দেশের পর্যটক ও স্থাপত্যবিদদের। প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক পরিদর্শন করে এই মসজিদ। নামাজের সময় বাদে ভীন্নধর্মালম্বীরাও মসজিদটির ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। তাবে তাদেরকে মসজিদের নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে একটি লম্বা আলখাল্লা সংগ্রহ করে পরতে হয়।
শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত মসজিদটির প্রবেশদ্বারের পাশেই একটি বেদিতে নিশ্চুপ বসে আছেন দেশটির কিংবদন্তি নকশাবিদ শিনান বিন আবদুল মেনান। মুসলিম বিশ্বে তিনি ‘মিমার শিনান’ নামেই পরিচিত। একটু আবছা অন্ধকারে দূর থেকে দেখলে মনে হবে তিনি নিমগ্ন চিত্তে নতুন কোন মসজিদের নকশার চিন্তায় বিভোর। প্রতিদিন নামাজ পড়তে যাওয়া মুসল্লিদের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। সবাই হাটাচলা করে; অজু করে; কথাও বলে। কিন্তু মিমার শিনান নিশ্চুপ নিথর। কারণ এই শিনানের অবয়ব আছে, দেহ আছে, কিন্তু তাতে প্রাণ নেই। এটি মিমার শিনানের ভাস্কর্য। তৈরি হয়েছে ব্রোঞ্জ দিয়ে। এই মসজিদটির নকশাও তিনি করেছিলেন। নির্মাণকাল ছিল ১৫৬৮ থেকে ১৫৭৫ সাল। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তুরস্কের তৎকালিন সুলতান সেলিম (দ্বিতীয়)।
১৫ শতকে শিনানের নকশায় করা স্থাপত্যকলা ইসলামী বিশ্বকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। মিমার শিনানের অমর কৃতির প্রতি সম্মান দেখাতেই সেলিমী মসজিদের সামনেই তার এই ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।
মুসলিম দেশে মসজিদের সামনে মূর্তি! যেখানে আমাদের দেশে হাইকোর্টের সামনের ‘মূর্তি’ আমাদের ‘ধর্ম নষ্ট করে’ সেখানে ইসলাম ধর্মের প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহি দেশ তুরস্কে এই ‘অনাচার’! তবে কি তারা সাচ্চা মুসলিম না? এটা কিভাবে সম্ভব! প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়।
বাংলাদেশে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোয়ানের ব্যপক খ্যাতি রয়েছে। বিশেষকরে করে কট্টর ইসলামপন্থীদের কাছে তিনি একজন মুসলিম বীর। কিছুদিন আগে তাঁর একটি ছবি এ দেশের ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ শেয়ার হয়েছিল ছবিটি। ছবিটিতে তিনি তাঁর নাতনিকে পবিত্র কোরআন পড়া শেখাচ্ছেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এদেশে এরদোয়ানের ভক্তকুল আজও জানে না কী পরিমান ‘মূর্তি’ রয়েছে এরদোয়ানের দেশে। একজন সাচ্চা মুসলমান হয়ে সেগুলো আজও কেন ভাঙছেন না তিনি! এ প্রশ্নের জবাব এদেশে তার ভক্তকুলের কাছে নেই।
সেলিমী মসজিদের মত তুরস্কের অনেক মসজিদের সামনেই ‘মূর্তি’ চোখে পড়বে। তুরস্কের ঐতিহাসিক শহর আনাতোলিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে ১২৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইভিলি মিনার মসজিদের (এটি আলাদিন মসজিদ বা উলু মসজিদ নামে পরিচিত) সামনে শোভা পাচ্ছে যুদ্ধংদেহী কামাল আতাতুর্কের ‘মূতি’। তাঁর সঙ্গে একজন নারী সহযোদ্ধার মূর্তিও রয়েছে স্থাপত্যটিতে। সুলতান আলাদিন কায়কোবাদ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা।
তুরস্কের আনাতোলিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে গ্র্যান্ড মসজিদের সামনে উদ্ধত তলোয়ার হাতে একটি দুরন্ত ঘোড়ার পিঠে কামাল আতাতুর্কের প্রস্তর মূর্তি জানান দিচ্ছে তাঁর শৌর্যবীর্য আর বীরত্বগাথা। এ ছাড়া শহরটির প্রাচীন পরিত্যক্ত রেলস্টেশন, যেটি বর্তমানে তুরস্ক ইউনিভার্সিটির অন্তর্ভুক্ত, এর সামনে বিশাল পার্কে শোভা পাচ্ছে ১৩ ফুট উচ্চতার একটি নারীমূর্তি, যার নামকরণ করা হয়েছে ‘ট্রিটি অব লাউসানি মনুমেন্ট’। ইস্পাতে তৈরি ওই তরুণী মূর্তিটির এক হাতে শোভা পাচ্ছে একটি দলিল, অন্য হাতে শান্তির প্রতীক পায়রা। ১৯৯৮ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের ৭৪ বছরের পূর্তি উপলক্ষে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। মূর্তিটির অন্তর্নিহিত বক্তব্য ‘শান্তি ও গণতন্ত্র’।
তুরস্কের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল মাসছয়েক আগে। প্রিন্সেস অব আইল্যন্ড নামে দ্বীপপুঞ্জের প্রতিটির পথে-ঘাটে দেখেছি কামাল আতাতুর্কের আবক্ষ মূর্তি। প্রতিটিতে তাঁর জন্ম সাল উল্লেখ করা থাকলেও মৃত্যুর তারিখটি ছিল উহ্য। তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের এ রকম অগণিত ভাস্কর্য পাওয়া যাবে।
ইস্তাম্বুলের বন্ধু গোয়েকে মেরিকের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে সে বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই বলল, “আজকে তুমি যে তুরস্ক দেখছ সেটা এই মোস্তফা কামালেরই অবদান। তাঁর কারণেই তুর্কি জাতি বিশ্বে একটি সম্ভ্রান্ত জাতির পরিচয় পেয়েছে। আমরা মনে করি, মোস্তফা কামাল আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। সেই চেতনা থেকেই তুরস্কে তাঁর কোনো আবক্ষ মূর্তিতে তুমি তাঁর মৃত্যুসালটি দেখতে পাবে না”।
বসফরাস প্রণালির পূর্ব পাশে এশিয়া আর পশ্চিমে ইউরোপ। সর্বত্রই হাজার বছরের পুরনো স্থাপত্য জানান দিচ্ছে দেশটির সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নিদর্শন। থাকসিম স্কয়ারের মাঝখানে দেখলাম চার-পাঁচটি মূর্তি, যেগুলো জানান দিচ্ছিল দেশটির বীর যোদ্ধাদের শৌর্যবীর্য। শুধু যে পর্যটকপ্রিয় এলাকাগুলোতেই এসব স্থাপত্য রয়েছে তা কিন্তু নয়; তুরস্কের ঐতিহ্যবাহী শহরগুলোর সব কটিতেই মূর্তি বা ভাস্কর্যের দেখা পাওয়া যাবে।
আসলে সভ্যতার শুরু থেকেই শিল্পকর্মের প্রতি মানুষের আলাদা একটা দুর্বলতা রয়েছে। এ কারণে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই ভাস্কর্য কিংবা সৃষ্টিশীল স্থাপত্যকর্মের সন্ধান পাওয়া যায়। এসব ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে দেশগুলো নিজ নিজ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ইত্যাদির পরিচয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরে
এ ধারার ব্যতিক্রম নয় বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোও। মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ভাস্কর্য বা মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। মুসলিম বিশ্বের মুরব্বি দেশ সৌদি আরবের কথাই ধরা যাক। জেদ্দার হাল হামারা এলাকায় উন্মুক্ত পার্কে রয়েছে দেশটির সবচেয় বড় ভাস্কর্য জাদুঘর। জেদ্দা স্থাপত্য পার্ক হিসেবে এটি পরিচিত। পার্কটিতে শোভা পাচ্ছে সৌদি আরবসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যতিমান স্থাপত্যশিল্পীদের শিল্পকর্ম। সাত বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই জাদুঘরটিতে একটি শিল্পকর্ম আছে মানুষের আদলে। ‘জয় অব লাইফ’ নামের এই ভাস্কর্যে দুটি মানুষের বিমূর্ত প্রতিকৃতি রয়েছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এসব ভাস্কর্যের বেশির ভাগই নির্মাণ করেছেন জগদ্বিখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পীরা। আবার তাদের অনেকেই ভীন্ন ধর্মালম্বী। রয়েছে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, ঘোড়া, উঁটসহ নানা ধরণের ভাস্কর্য। যদি জন্তুর ভাস্কর্য নাজায়েজ হবে তবে কেন সৌদি আরবে এসব ভাস্কর্য থাকবে? তাদের চেয়েও কী আমরা সাচ্চা মুসলিম?
যে কারণে এতসব কথার অবতারণা তার প্রেক্ষাপট হলো আমাদের সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেমিসের ভাস্কর্যটি নিয়ে ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের অতিরিক্ত গ্রাত্রদাহ। ইন্টারনেটে খুঁজলে পৃথিবীর বহু দেশে বিচারালয়ের সামনে থেমিসের ভাস্কর্য পাওয়া যাবে। আর সেসব দেশ থেমিসকে পুজো দিয়ে নয়, আইনের অনুসাশনের প্রতিকৃতি হিসেবেই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে মূর্তি ভাঙা বা মূর্তি নিয়ে বিরোধ বেশি দিনের পুরনো ইতিহাস নয়। শুরুটা হয়েছিল ২০০১ সালে আফগান তালেবানের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে। সেবছরের ২ মার্চ ছিল বিশ্ব ঐতিহ্যের জন্য একটি কালো দিন। এদিন ‘নাজায়েজ’ আখ্যা দিয়ে আফগনিস্তানের সিল্ক রোডের পাশে বামিয়ান উপত্যকায় দুই থেকে তিন শতকে নির্মিত ‘দাঁড়ানো বুদ্ধ’র মূর্তিটি ভাঙা শুরু করে উগ্র ইসলামপন্থী তালেবানরা। টানা ছয় দিন ধরে ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন দিয়ে তারা ধুলায় পরিণত করে বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রাচীনতম সমৃদ্ধ এই শিল্পকর্মটিকে। এটি ছিল ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অন্যতম স্থাপত্য।
বাংলাদেশেও এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল ২০০৮ সালে। বাউলসাধক লালন শাহ বাংলদেশ ও বাঙালির অমূল্য সম্পদ। এ দেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে লালন শাহ ও বাউল গানের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অথচ ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর তালেবানের মতোই এ দেশীয় কিছু উগ্র মৌলবাদীরা বিমানবন্দর থেকে গুঁড়িয়ে ফেলে লালন শাহসহ আরও তিন বাউল মূর্তি। তৎকালীন দাপুটে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চোখের সামনেই এ ঘটনা ঘটেছিল। সেদিন নারায়ে তাকবীর ধ্বনি দিয়ে মূর্তিগুলোর গলায় রশি পরিয়ে অনেক উদ্যাম উল্লাস প্রকাশ করেছিল তারা। সে উল্লাসের মধ্যে ছিল হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রবল আনন্দ। বাংলাদেশের সংস্কৃতিকর্মী বাদে পুরো জাতি সেদিন নিশ্চল প্রত্যক্ষ করেছিল উগ্র মৌলবাদীদের আদিম উল্লাস। এ ধরনের বিজয় তাদের দিন দিন সাহসী করে তুলছে, করছে শক্তিশালীও।
বর্তমানে যে দলগুলো এই ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছেন তাদের মধ্যেই বিরাজ করছে ২০০৮ এর সেই অপশক্তির ছায়া। ২০০২ সাল থেকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দেশজুড়ে যে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি করেছিল তারই এক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ২০০৮ সালের ১৫ অক্টোবর। এ দেশে এখনো স্বাধীনতাবিরোধী একটি বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা বাঙালি সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে বিশ্বাস করে না। সরাসরি তারা নিজেদের প্রকাশ না করতে পারলেও বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী কট্টর বা উগ্র অবস্থান থেকে তারা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয় সুযোগ পেলেই।
এই গোষ্ঠী বারবার আঘাত হেনেছে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর। তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি মতিঝিলের বিমান অফিসের সামনের বলাকা ভাস্কর্যটিও। ২০০৮ সালের কোনো এক রাতে একটি বলাকার পা গুঁড়িয়ে দিয়েছিল তারা। চোখের সামনে এমন অপকর্ম দেখেও সেসময়কার ক্ষমতাসীন সরকার চুপ থেকেছে। তাদের আশকারা দিয়েছে।
বাংলাদেশে যারা এই ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে, মধ্যপ্রাচ্যের ইমামরা কখনোই কেন তাদের দেশে স্থাপিত ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। আসলে সেখানকার ধর্মীয় নেতারা জানেন, কোরআন ও রাসুল (সা.) সুস্পষ্টভাবে প্রতিমাকে নিষিদ্ধ করেছেন। মূর্তিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেগুলোকে মানুষ পূজা দেয়। এর বাইরে যেসব মূর্তি বা ভাস্কর্য রয়েছে সেগুলোকে বৈধতা দিয়েছেন তাঁরা। এ কারণেই ইসলাম ধর্মের সূতিকাগার মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় প্রাচীনকাল থেকেই শিল্প-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। এসব অঞ্চল ঘুরলে অসংখ্য মূর্তি বা ভাস্কর্য পাওয়া যাবে, যার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো বিরোধ নেই। এসব অঞ্চলের বেশ কটি ভাস্কর্যকে ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান পেয়েছে।
ভাবতে অবাক লাগে, ঠিক যেই মুহূর্তে মানুষ মঙ্গল গ্রহে বসবাসের চিন্তা করছে, ঠিক তখনই বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে মূর্তি ভাঙা যায় সেই যুদ্ধে লিপ্ত।
ইন্টারনেট ঘাটলে পৃথিবীর অনেক দেশেই মসজিদের সামনেই মূর্তি বা ভাস্কর্যের সন্ধান মিলবে। আলবেনিয়ার রাজধানী তিরানার ইথাম বে মসজিদের সামনে পাওয়া যাবে দেশটির জাতীয় বীর সিকান্দার বেগের মূর্তি। সঙ্গে একটি ঘোড়াও রয়েছে।
লেবাননের বৈরুতে মোহাম্মদ আল আমিন মসজিদের প্রধান ফটকের বাইরে পাওয়া যাবে ‘মাট্রেস মনুমেন্ট’। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত আরব ও লেবানিজদের স্মরণে তৈরি করা হয়েছিল। ১৯১৬ সালে ওই স্থানে সর্বশেষ অটোমান সামরিক শাসক জামাল পাশা বহু লেবানিজ ও আরবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। তাদের স্মরণে এই পাথরের তৈরি স্থাপত্য। স্থাপত্যটিতে তিনটি মূর্তি রয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন নারী, একজন খ্রিস্টান অন্যজন মুসলিম। তারা একে অপরের হাত ধরে একটি কফিনের দিকে তাকিয়ে আছে। ১৯৩০ সালে এই স্থাপত্যটি নির্মাণ করেছিলেন ইতালির খ্রিস্টান ভাস্কর মারিনো মাজারাতি। মজার ব্যাপার হলো, এর বহু বছর পরে ২০০২ সালে এই স্থাপত্যের পাশেই নির্মিত হয় মোহাম্মদ আল আমিন মসজিদ।
ইরানের ইয়াজদ প্রদেশে আমির চাকমাক কমপ্লেক্সের সামনেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ‘টার্কিশ গোসলের’ তিন মূর্তির ভাস্কর্য। এগারো শতকে আজারবাইজানে জন্ম নেওয়া পারস্যের বিখ্যাত কবি আফজালউদ্দিন বাদিল (ইব্রাহিম) যিনি ‘খাকানি’ নামে ব্যাপক পরিচিত ছিলেন তাঁর একটি শ্বেত পাথরের মূর্তি রয়েছে ইরানের তাবারজ শহরের ব্লু মসজিদের সামনে।
মিসরের কায়রো শহরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে তেরো শতকে মামলুক সুলতান নাসির মোহাম্মদের তৈরি একটি বিশাল ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। এটি মোহম্মদ আলী মসজিদ হিসেবেই পরিচিত। মসজিদটির প্রধান ফটকেই রয়েছে মিসরের বীর যোদ্ধা ও আঠারো শতকের সেনাপ্রধান আনোয়ার (ইবরাহীম) পাশার যুদ্ধংদেহী মূর্তি। পৃথিবীর আরও অনেক মুসলিম দেশগুলোতে এ রকম অনেক মূর্তি পাওয়া যাবে, যেগুলো ওই সব দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।
শুধু মসজিদ কেন? বিচারালয়ের সামনেও এ রকম মূর্তি দেখতে পাওয়া যাবে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের ১০ জানুয়ারি ২০১৫ সালের ‘আ স্ট্যাচু অব মোহাম্মদ, টেকেন ডাউন ইয়ার এগো’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯০২ সালে মার্বেল পাথরে তৈরি এক হাজার পাউন্ডের রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি মূর্তি বসানো হয়েছিল নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারের সামনে ম্যাডিসন আপিল বিভাগের কোর্ট হাউসের ছাদে। এটি নির্মাণ করেছিলেন মেক্সিকোর ভাস্কর চার্লস আলবার্ট লোপেজ। রাসুল (সা.) একা নন, আইন তৈরি করে পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন এ রকম আরো আটজনের মূর্তি বসানো হয়েছিল আপিল বিভাগের ছাদের প্রতিটি কোনায়। এদের মধ্যে কনফুসিয়াস ও মুসার মূর্তিও রয়েছে। তবে মুসলিম বিশ্বের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫৫ সালে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মূর্তিটি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মূর্তিটি নিউজার্সির কোনো এক গুদামঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
বাঙালি জাতির হাজার বছরের সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের মধ্যে শিল্প-সাহিত্য একটি বিশেষ জায়গা দখল করে রেখেছে। আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের ভাস্কর্যশিল্পের বিকাশে মহান মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ দেশে স্বাধীনতার পর পর মুক্তিযুদ্ধের অনেক ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। আমরা যেভাবে ভাস্কর্য ভাঙা বা সরানোর সাংস্কৃতিতে যুক্ত হচ্ছি তাতে মনে হয় একদিন এই মুক্তিযুদ্ধেও ভাস্কর্যগুলোর দিকেও চোখ পড়বে এই অপশক্তির। একদিন হয়তো তাদের আক্রমণ আসবে সরাসরি।
ইসলামে মূর্তি নিষিদ্ধ নয়, মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ। ভাস্কর্য নিষিদ্ধ নয়, প্রতিমা নিষিদ্ধ। ইসলামে মানুষ, জীবজন্তু, প্রাকৃতিক উপাদান কোনো কিছুরই চিত্র বা মূর্তি (পোশাকি ভাষায় ভাস্কর্য) নির্মাণ অবৈধ নয়। তবে সেই মূর্তি বা চিত্রকলা যদি অশ্লীল হয়, যদি মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয়, যদি সেগুলো সম্মানিত কাউকে অসম্মান করার লক্ষ্যে সৃষ্ট হয় তাহলে সেটা ওই কারণে অবৈধ হবে। আর উপাসনা বা পূজা করার জন্য মূর্তি, চিত্র যা কিছুই বানানো হোক না কেন সবই নিষিদ্ধ। সুতরাং বর্তমানে ইসলামের দোহাই দিয়ে যেভাবে হাজার হাজার বছর আগের প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করা হচ্ছে সেটাকে ইসলাম সমর্থন করে না। বরং এ ধরনের কর্মকাণ্ড ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি।
দশম হিজরির জিলহজ মাসের ৯ তারিখে আরাফাতের বিশাল ময়দানে এক লাখ ১৪ হাজার সাহাবির সামনে ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে কঠিনভাবে নিষেধ করে গিয়েছিলেন। ভাষণের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে তিনি বলেছিলেন, ‘সাবধান, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কোরো না। এ বাড়াবাড়ির কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।
পাঠক নিচের উল্লেখিত মুসলিম দেশগুলোতে নি¤েœাক্ত ভাস্কর্য্য রয়েছে। যাতে সেই দেশের ঐতিহ্য, সংগ্রাম ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে।
* তুরস্কের ইদারান শহরের ঐতিহ্যবাহি সেলীমি মসজিদে ঢোকার মুহুর্তেই চোখে পড়বে মসজিদটির নকশাবিদ মিমার শিনানের এই মূর্তি।
* পারস্যের বিখ্যাত কবি আফজালউদ্দীন বাদিল (ইব্রাহিম) যিনি খাকানি নামে ব্যপক পরিচিত ছিলেন। শ্বেত পাথরে তৈরী তার একটি ভাস্কর্য আছে ইরানের তাবারজ শহরের ব্লু মসজিদের সামনে।
* সৌদি আরবের জেদ্দার স্থাপত্য পার্কে শোভা পাচ্ছে ‘জয় অব লাইফ’ নামের এই ভাস্কর্যটি। এতে দুটি মানুষের বিমূর্ত প্রতিকৃতি রয়েছে।
* আলবেনিয়ার রাজধানি তিরানার ইথাম বে মসজিদের সামনে শোভা পাচ্ছে আলবেনিয়ার জাতীয় বীর সিকান্দার বেগের ভাস্কর্য।
* তুরস্কের আনাতালিয়ার পরিত্যক্ত রেলষ্টেশন এর সামনে বিশাল পার্কে শোভা পাচ্ছে তেরো ফুট উচ্চতার একটি নারী ভাস্কর্য যার নামকরণ করা হয়েছে ‘ট্রিটি অব লাউসানি মনুমেন্ট’।
* লেবাননের বৈরুতে অবস্থিত মোহম্মদ আল আমীন মসজিদের প্রধান ফটকের বাইরে শোভা পাচ্ছে মাট্রেরস মনুমেন্ট। এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত আরব ও লেবানিজদের সম্মানে তৈরী করা হয়েছে।
* দুবাইয়ের বুর্জ খলিফার সামনে ‘টুগেদার’ নামে আরব নারী-পুরুষের ভাস্কর্য।
* মিশরের কায়রো শহরের প্রাণকেন্দ্রে মোহম্মদ আলি মসজিদটির প্রধান ফটকেই রয়েছে ইজিপসিয়ান বীর যোদ্ধা ও ১৮ শতকের সেনা প্রধান ইব্রাহিম পাশার যুদ্ধাংদেহী মূর্তি।
* ইরানের ইয়াজদ প্রদেশে আমির চাকমাক কমপ্লেক্স মসজিদের পাশেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহি টার্কিস গোসলের ভাস্কর্য।
* তুরস্কের ঐতিহাসিক শহর এনাতালিয়ার কেন্দেবিন্দুতে বারোশো ত্রিশ সালে প্রতিষ্ঠিত ইভিলি মিনারে মসজিদের (এটি আলাদিন মসজিদ বা উলু মসজিদ নামে পরিচিত) সামনে শোভা পাচ্ছে যুদ্ধাংদেহী কামাল পাশার ভাস্কর্য।
-তথ্য সাজ্জাদুল ইসলাম নয়ন, সভাতি কালের কণ্ঠ শুভ সংঘ।