বিশেষ প্রতিনিধি::
ছাতক-সুনামগঞ্জ রেললাইন সম্প্রসারণের নিয়ে এখন উত্তপ্ত সুনামগঞ্জ জেলা। সম্প্রসারিত রেললাইনের স্থান নির্ধারণসহ নানা বিষয়ে নিয়ে সজ্জন রাজনীতিক খ্যাত পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের বিরুদ্ধে জেলার ৫ জন সংসদ সদস্য অবস্থান নেওয়ার ঘটনাকে সুনামগঞ্জের উন্নয়নের অন্তরায় বলে মনে করছেন সুধীজন। উল্লেখ্য এর আগেও জেলার ৫ জন সংসদ সদস্য সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন শেষে স্থান নির্ধারণ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে সংসদে কথা বলেছিলেন এবং শিক্ষামন্ত্রী বরাবরে ডিও দিয়েছিলেন। এবারও তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গত ৬ জুন ছাতক থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে সুনামগঞ্জ পর্যণÍ রেললাইন সম্প্রসারণের বিষয়ে রেলমন্ত্রী বরাবর আধা সরকারি পত্র দিয়েছেন। উন্নয়ন নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়ানোকে অনভিপ্রেত বলছেন সুধীজন। তাছাড়া গতানুগতিক বিষয় নিয়ে বারবার এলাকার উন্নয়ন বিষয়ে প্রকাশ্যে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান করায় ক্ষোভও প্রকাশ করছেন সাধারণ মানুষ।
সুধীজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৫৪ সনে সিলেট থেকে ছাতকে রেললাইন স্থাপিত হয়। রেললাইন স্থাপনের ৬৭ বছর হলেও এখনো জেলা শহরে আসেনি রেললাইন। ২০১১ সালে রেলমন্ত্রী হিসেবে হাওরের নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দায়িত্বগ্রহণের পর দাবিটি জোড়ালো হয়। ২০১২ সনের মার্চ মাসে সুনামগঞ্জে এক সংবর্ধনার জবাবে ছাতক থেকে সুনামগঞ্জে রেললাইন সম্প্রসারণের গণদাবিটি বাস্তবায়িত হবে বলে আশ্বাস দেন সুরঞ্জিত। ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর এই কার্যক্রমটি মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শেষ নির্বাচনী জনসভায় সুনামগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেললাইন সম্প্রসারণের ঘোষণা দেন। তিনি পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেবার পর সুনামগঞ্জ স্টেডিয়ামে জনসভায়ও আবারও আশ্বাস দেন।
জানা গেছে পরিকল্পনামন্ত্রীর মন্ত্রীর একাগ্রতায় রেললাইনের এলাইনমেন্ট তৈরির কাজ শুরু হয় দ্রুত গতিতে। নিয়োগ দেওয়া হয় টেকনিক্যাল এক্সপার্ট। সমীক্ষার সময় ছাতক দোয়ারাবাসী দাবি করে ছাতক পৌর শহর থেকে সুনামগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের। তাদের দাবির প্রতি একাত্মতা জানান সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। এদিকে একই সময় দক্ষিণ ছাতকবাসীসহ বিভিন্ন এলাকাবাসী গোবিন্দগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়ক হয়ে সুনামগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণের দাবি তুলেন। তারা বলেন ব্যবসা, বাণিজ্য ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রে গোবিন্দগঞ্জ সুনামগঞ্জ রেললাইন সম্প্রসারণই উপযুক্ত।
সুবিধাভোগী এলাকার জনপ্রতিনিধি ছাতক দোয়ারা আসনের সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক ও সুনামগঞ্জ-৪ আসনের জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত এমপি এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এই দাবির পক্ষে মাঠে নামেন। সম্প্রসারিত রেললাইনের সুবিধার বাইরে অবস্থান করেও অযৌক্তিকভাবে এই দাবির প্রতি একাত্মতা জানান সুনামগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ড. জয়া সেনগুপ্তা, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এবং সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ও সুনামগঞ্জ-১ আসনের বাসিন্দা এডভোকেট শামীমা শাহরিয়ার। তারা সবাই ছাতক শহর থেকে সুনামগঞ্জ শহর পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণে গত ৬ জুন রেলমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাদের সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের বিরুদ্ধাচরণ করে বক্তব্য বিবৃতি প্রদান করছেন।
এভাবে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে কর্মসূচি পালন করায় আওয়ামী লীগের সচেতন নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষজন এমন আচরণকে উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে ভাবছেন। তারা সুনামগঞ্জের সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নে বিরোধে না গিয়ে সহযোগিতা ও আলোচনার মাধ্যমে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি লতিফুর রহমান রাজু বলেন, আমাদের জাতীয় নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দ্বন্ধের কারণে কাঙ্খিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত ছিলাম। দেশব্যাপী সজ্জন রাজনীতিবিদ এমএ মান্নানকে আমরা আবার জাতীয় নেতা ও মন্ত্রী হিসেবে পাওয়ায় নানা ক্ষেত্রে উন্নয়ন পাচ্ছি। কিন্তু সম্প্রতি মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ আলোচনা না করেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গিয়ে অবস্থান নেওয়ায় আমরা আবারও উন্নয়ন বঞ্চনার আশঙ্কা আছি।
জেলা আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ও তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, আমরা জেলার উন্নয়নের স্বার্থে কোন উন্নয়নবিরোধী জোট চাইনা। আমরা চাই জেলার যে কোন স্থানেই উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হোক। উন্নয়ন নিয়ে এভাবে বিভক্ত হলে এবং আমাদের সৎ ও সজ্জন মন্ত্রী এমএ মান্নানকে প্রশ্নহীনভাবে কাঠগড়ায় দাড় করালে আমাদেরই ক্ষতি। সবার উচিত তাকে সহযোগিতা করা।
সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নূরুল হুদা মুকুট বলেন, আমরা সুনামগঞ্জবাসী দীর্ঘদিন উন্নয়ন বঞ্চিত ছিলাম। এমএ মান্নানকে প্রতিমন্ত্রী ও মন্ত্রী পেয়ে আবার উন্নয়নের সমতায় ফিরেছি। কিন্তু আমাদের সংসদ সদস্যবৃন্দ একজন সৎ মন্ত্রীকে সহযোগিতার বদলে অসহযোগিতা করে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছেন। তিনি বলেন, আমাদের জেলার যে কোন স্থানেই উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে আমাদের সবাইকে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধে ওঠে মেনে নিতে হবে।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, একটি মহল মন্ত্রী মহোদয়কে বুঝিয়ে ছাতক শহরের বদলে গোবিন্দগঞ্জ থেকে রেললাইন সম্প্রসারণ করার চেষ্টা করছে। আমরা ঠের পেয়ে ৫ জন সংসদ সদস্য ছাতক শহর থেকে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণে ডিও দিয়েছি। আমরা কর্মসূচি থেকে পিছাবনা।
সুনামগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, রেললাইন কোন দিকে সম্প্রসারণ হবে এটা এক্সপার্টরা বুঝবে। আমার কোন মতামত নেই। কিন্তু মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ কোন কারণ ও আলোচনা ছাড়াই আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনকে এগিয়ে নিতে তার কর্মী হিসেবে কাজ করছি। তিনি যতদিন চাইবেন আমি ততদিন নীতি ও আদর্শ মেনে মানুষের উন্নয়নে কাজ করে যাব।
(দৈনিক সুনামকণ্ঠ)