প্রতিবছর জুন মাস এলেই শরীর ও মগজ কেমন জানি ছটফটায়। এ মাসেই ১৯৯৬ সালের ১২ তারিখ পার্বত্য চট্টগ্রামের নিউলাল্যাঘোণা গ্রাম থেকে সেনাবাহিনী অপহরণ করে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেতা কল্পনা চাকমাকে। এ মাসের ৩০ তারিখ ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয় হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ। এ মাসেই হাওরাঞ্চলে কৃষিমজুরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানো হয় কর্মাদি বা কর্মপুরুষ বর্তের মাধ্যমে। এ মাসের ৫ জুন দুনিয়া জুড়ে পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। ধরণী মায়ের এক বিশেষ কৃত্য অম্বুবাচী বা আমাতিও পালিত হয় এ মাসেই। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমার মন পড়ে থাকে ১৪ জুনের দিকে। ১৯৯৭ সালের এ দিনে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় বিস্তৃত দেশের এক অবস্মিরণীয় বর্ষারণ্য লাউয়াছড়ার মাগুরছড়া এলাকা কর্পোরেট গ্যাস কোম্পানি অক্সিডেন্টালের দায়িত্বহীনতায় জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ১৪ জুন আসার আগে শ্রীমঙ্গলের লিটনদা সহ কয়েকজন সাংবাদিক যোগাযোগ করেন। মাগুরছড়া বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য আছে কিনা, সাধ্যমত দিনটিকে নিয়ে তারা পত্রিকায় সংবাদ পাঠান। মাগুরছড়ার গ্যাসসম্পদ ও পরিবেশ ক্ষতিপূরণ আদায়ে জাতীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক সৈয়দ আমিরুজ্জামান খোঁজ খবর করেন। শ্রীমঙ্গলের হাইল নামের একটি সংগঠনের সোহেল শ্যাম এবং সৈয়দ আমিরুজ্জামান মিলে ঘটনার কয়েকবছর পর মাগুরছড়ার ন্যায়বিচারের দাবিতে শ্রীমঙ্গলে একটি সেমিনার করতে চাইলে প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো অনুমতি পাননি। সম্প্রতি ঢাকার নিমতলী অগ্নিকান্ডের দিকে রুদ্ধ হয়ে থাকা বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে বারবার আমার মনে হয়েছে এ ঘটনা এভাবেই আমরা ভুলে যাবো। ঠিক যেমন মাগুরছড়ার কথা নিলর্জ্জ আর পাষাণের মত আমরা বেমালুম বিস্মৃত হয়েছি। প্রতিবছর ভাবি এ নিয়ে লিখে আর বলে কি হবে? কেউ তো শুনে না, নাকি শুনতে চায় না। কিন্তু মন মানে না, শরীর মানে না। প্রশ্নহীন আগুনের সেই দগদগে অভিজ্ঞতার কথা মনে এলে আর কিছুই সামলাতে পারিনা। মাগুরছড়া অগ্নিকান্ডের পর যতবার লাউয়াছড়া কি মাগুরছড়া গিয়েছি তীব্র অপরাধে আমি এখনো এই ক্ষতঅলা রক্তাক্ত বনের দিকে তাকাতে পারিনা। দমবন্ধ করে লুকিয়ে ছাপিয়ে চলে যাই লাউয়াছড়া কি মাগুরছড়া খাসি পুঞ্জিতে বা ডলুবাড়ি ত্রিপুরী কামিতে কি ফুলবাড়ি চা শ্রমিক বস্তিতে। পুড়ে যাওয়া অতীত যাতে কেউ ঘাটাবাছা না করে সারাটাসময় ঝলাসানো স্মৃতির দিকে তাকিয়ে থাকি। ১৯৯৭ সালের জুনের শেষের দিকে মাগুরছড়ায় সপরিবারে নিহত পাখি-পতঙ্গ-বৃক্ষের লাশ ছুঁয়ে বলেছিলাম এর বিচার হবে। বাংলাদেশ তার প্রিয়তম সন্তানের এমন করুণ মৃত্যুর বিচার করতে পারবে। কিন্তু একটি দুটি দিন নয়, গত চব্বিশ বছরেও আমরা এই মুমূর্ষু বনের প্রতি ন্যায়পরায়ণ হতে পারিনি। কেউ মাগুরছড়া অগ্নিকান্ডের বিচার ও প্রতিবেশীয় ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে একটুকুও মায়া বা দরদ দেখায়নি। তাহলে কি হবে ছিঁচকাদুনে পরিবেশের মায়াকান্না বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে? কি হবে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ‘আমরা ডুবে মরলাম গো’ বলে চিৎকার করে? আমরা তো দেশের এক নৃশংস পরিবেশ-গণহত্যারই সুবিচার করতে পারিনি এখনো।
নিপীড়িত মাগুরছড়া-লাউয়াছড়া বনভূমির আদিবাসী খাসি, ত্রিপুরী, চা শ্রমিক জনেগোষ্ঠী এবং দরিদ্র অভিবাসী বাঙালিরা মনে করে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনছন্দ এক ও অভিন্ন। লাউয়াছড়া বর্ষারণ্য ঘিরে এমনই এক জটিল প্রতিবেশ সম্পর্ক ী জীবন দর্শন গড়ে ওঠেছে মানুষ কি বনের প্রাণবৈচিত্র্যের ভেতর। প্রবল ক্ষমতাশালী মত গুলো এসব চিন্তাকে দাবিয়ে রাখে, পাত্তা দেয় না, স্বীকৃতি দিতে চায় না। তাই এই বনভূমি পুরুষতান্ত্রিক কর্পোরেট উন্নয়ন দ্বারা বারবার ধর্ষিত ও রক্তাক্ত হয়েছে। গণহত্যা কেবল মানুষ এবং মানুষের সমাজেই সংগঠিত হয়না। গণহত্যা সংগঠিত হয় প্রতিবেশ পরিবেশকে ঘিরেও। যদিও মানুষ অন্যসব প্রাণের মতোই এই প্রতিবেশেরই এক অনন্য অংশ । নদী কি জলধারাকে হত্যা করা হয়, পাহাড়কে ধর্ষণ করা হয়, বনভূমিকে ফালি ফালি করে খুন করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন অক্সিডেন্টালের অবিবেচক পরিচালনায় একসাথে সপরিবারে নিহত হয় লাউয়াছড়া বনভূমির লক্ষ হাজার প্রাণ। একইসাথে বৃক্ষ-পতঙ্গ-পাখি-পাহাড়ি ছড়া-মাটি-অণুজীব-ছত্রাক-পরাশ্রয়ী লতা গুল্ম-মাছ-সরীসৃপ-বন্যপ্রাণী-ব্যাঙ-পানজুম প্রশ্নহীনভাবে নিহত হয়। বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রতিবেশ হত্যার ইতিহাসে এতো লাশের মিছিল লাউয়াছড়া ছাড়া আর কোথাও সমকালে দেখা যায়নি। হয়তো দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটিই দেশের সবচে’ বড় পরিবেশ-গণহত্যা। বনভূমির পাশাপাশি খাসি-ত্রিপুরী এবং চাবাগান শ্রমিকেরা আহত হন, চেনাজানা জীবনজীবিকা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে যান অনেকেই।
সকল গণহত্যারই সুবিচার হওয়া জরুরী। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অপরাধের বিচার চাওয়া সকলেরই সাংবিধানিক অধিকার। মাগুরছড়া-লাউয়াছড়া বনভূমি ১৪ জুন পরিবেশ-গণহত্যাসহ এই বনভূমির উপর সকল ধরনের হামলা ও নির্যাতনের বিচার চায় এখনো। মাগুরছড়া অগ্নিকান্ডের পর এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, বাংলাদেশ বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই নিজস্ব হিসাবে ক্ষতির নানান হিসাব করেছে টাকার মুদ্রায়। ২৪ বছর ধরে মাগুরছড়া বিষয়ে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ বনের ক্ষতিপূরণ ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে কথা বলা হলেও এই নৃশংস পরিবেশ-গণহত্যার সুবিচারের জন্য কোনো উদ্যোগই তৈরি হয়নি। বরং বারবার এই বনভূমিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে একটির পর একটি কর্পোরেট কোম্পানির জখমের ভেতর। প্রাকৃতিক বন ও সৃজিত বাগান মিলেমিশে এক জটিল মিশ্র চিরহরিৎ বর্ষারণ্যের বাস্তুসংস্থান গড়ে ওঠেছে লাউয়াছড়ায়। দেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ১০টি জাতীয় উদ্যানের ভেতর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানই বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক গিবনের সবচে’ বড় বিচরণ এলাকা। মৌলভীবাজার রেঞ্জের ২,৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ)(সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ঘোষণা করা হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মার্কিন কোম্পানি অক্্িরডেন্টালের মাধ্যমে এক ভয়াবহ বিস্ফোরনে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় লাউয়াছড়া বনের প্রতিবেশ ও জীবনব্যবস্থা। পরবর্তীতে আরেক মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন বসায়, যার ফলে এই সংবেদনশীল বনভূমির বাস্তুসংস্থান অনেকটাই উল্টেপাল্টে যায়। মাগুরছড়া পরিবেশ-গণহত্যার পর ২০০৮ সালে রাষ্ট্রের অনুমোদন নিয়ে ভুতাত্ত্বিক গ্যাস জরীপের নামে মার্কিন কোম্পানি শেভরন লাউয়াছড়া বনভূমিতে প্রশ্নহীন বোমা বিস্ফোরনে ঝাঁঝরা করে দেয় বনের মুমূর্ষু শরীর। পরবর্তীতে এই বনভূমিতে চালু হয় নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প এবং তার ল্যাজ ধরে আইপ্যাক কর্মসূচি। এসব বহুজাতিক খনন কী সংরক্ষণ প্রকল্প মাগুরছড়া পরিবেশ-গণহত্যা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলেনি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস মাগুরছড়া পরিবেশ-গণহত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সাহসী হবে। রাষ্ট্রের কলিজায় ছলকে ওঠবে এক মুর্মূষৃ বনের প্রতি অবিস্মরণীয় প্রতিবেশ দরদ।
##
পাভেল পার্থ। গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ। animistbangla@gmail.com