বিশেষ প্রতিনিধি ::
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দীর্ঘ পাঁচ দশকের পথচলায় তারা কখনো অকৃত্রিম বন্ধুত্ব থেকে বিচ্যুত হননি। একে অন্যের খুশিতে তারা আনন্দিত হন। দুঃখে ব্যথিত। কিন্তু সম্প্রতি ছাতক থেকে দোয়ারা হয়ে ইউটার্ন আকৃতিতে সুনামগঞ্জ শহরে রেললাইন সম্প্রসারণের দাবিতে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যসহ সুনামগঞ্জের ৫ জন সংসদ সদস্যের দাবির অনুকূলে একটি ডিও লেটার দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই ডিওকে সুনামগঞ্জের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহসহ জেলার আরও তিনজন সংসদ সদস্য ‘মুখ্য অস্ত্র’ হিসেবে এখন ব্যবহার করে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তাদের অন্যান্য বন্ধুরা এ ঘটনায় মর্মাহত। এই অবস্থায় গত ১৪ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার নিজস্ব আইডি থেকে একটি স্টেটাস দিয়েছেন। স্টেটাসে তিনি অকৃত্রিম বন্ধুত্বের কথা স্বীকার করলেও রেললাইন সম্প্রসারণ সংক্রান্ত ডিও লেটারকে কেন্দ্র করে কোন বক্তব্য দেননি।
সুনামগঞ্জের ৫ জন সংসদ সদস্য চলতি বছরের শুরু থেকেই নানা দাবি-দাওয়াকে কেন্দ্র করে পরিকল্পনামন্ত্রীর সঙ্গে মানসিক দূরত্বে আছেন। গোবিন্দগঞ্জ থেকে সহজ পথে সুনামগঞ্জ রেললাইন সম্প্রসারণের জনদাবিকে তারা পাশ কাটিয়ে একাট্টা হয়েছেন ছাতক থেকে দোয়ারাবাজার হয়ে ইউটার্ন আকারে রেললাইন সুনামগঞ্জ শহরে নিয়ে আসার জন্য। তবে সরকারের সমীক্ষা দল ইউটার্ন রেললাইনের বদলে সরাসরি গোবিন্দগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জ শহরে রেললাইন নিয়ে আসার প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। এই বিষয়টি অবগত হয়ে সুনামগঞ্জ-৪ আসনের জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এবং সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারাবাজার) আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিক দোয়ারা হয়ে ইউটার্ন আকারে রেললাইন সম্প্রসারণের দাবি জানান। নিজেদের অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ায় সুনামগঞ্জ-২ আসনের এমপি ড. জয়া সেনগুপ্তা, সুনামগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শামীমা শাহরিয়ারও ওই দুই সংসদ সদস্যের সঙ্গে এই দাবির প্রেক্ষিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রেলমন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিয়েছেন। যদিও তাদের এলাকাবাসী এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। বরং গোবিন্দগঞ্জ হয়ে সুনামগঞ্জে রেললাইন সম্প্রসারণ হলে তারা উপকৃত হবেন এমন মতামত দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করছেন। সংসদ সদস্যদের ঘনিষ্ঠজনরা এ ঘটনায় পরিকল্পনামন্ত্রীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিয়মিত লেখালেখিও করছেন। অন্যদিকে দক্ষিণ ছাতকসহ দিরাই-শাল্লাবাসী ড. জয়া সেনগুপ্তা কার স্বার্থে ইউটার্ন আকৃতিতে রেললাইন চান জানতে চেয়েছেন। তবে পরিকল্পনামন্ত্রী বরাবরই সরকারের বিশেষজ্ঞরা যেদিকে চাইবেন সেদিকেই তিনি রেললাইন সম্প্রসারণ মেনে নিবেন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
এই অবস্থা যখন চলছে তখন গত ১০ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সুনামগঞ্জের জাতীয় পার্টির এমপিসহ আওয়ামী লীগের এমপিদের ডিও লেটারকে যথার্থ উল্লেখ করে তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে একটি ডিও লেটার দেন। এ নিয়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জে দুই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠরাও বিব্রত হন। তাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। এ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে লেখালেখিও হয়। যার দৃষ্টি আকর্ষণ হয় দুই মন্ত্রীর।
গত ১৪ জুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্টেটাস দেন। ওই স্টেটাসে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মান্নান আমার বন্ধু, মান্নানের সাথে আমার সম্পর্ক ৫০ বছরের অধিক। আমি এবং মান্নান সুখে-দুখে সবসময়ই ছিলাম এবং আছি, ভবিষ্যতেও আমৃত্যু থাকব বলেই আশা করি। দুঃখজনক যে সিলেটের একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে দেখলাম আমার এবং মান্নানের মধ্যে নাকি দ্বন্দ্ব রয়েছে, এবং এই দ্বন্দ্বের কারণে নাকি সিলেটের অনেক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। কে বা কারা এই সংবাদটি প্রচার করেছেন জানিনা তবে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং বানোয়াট। যে বা যারা এটি প্রচার করেছেন তারা হয়তোবা কোন বিশেষ বা অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য করেছেন। ফেসবুকে এই স্টেটাসটির প্রয়োজন আছে বলে মনে করছিনা তবে একটি বিশেষ কারণে দিচ্ছি আর তা হলো আমার এবং মান্নানের স্থানীয় অনেক শুভাকাক্সিক্ষ রয়েছেন আর তাদের মধ্যে যাতে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয়। দোয়া রইল। আব্দুল মোমেন’। তবে এই স্টেটাসে রেললাইন নিয়ে তিনি যে ডিও লেটার দিয়েছেন তার কোন কথা উল্লেখ ছিলনা। যার ফলে তার অবস্থান নিয়ে ঘনিষ্ঠজনরা এখনো স্পষ্ট নন।
এদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই স্টেটাসের পর পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানও এ বিষয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি রোববার (২০ জুন) স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মোবাইল ফোনে একটি বার্তা প্রেরণ করেছেন। ইংরেজিতে লেখা পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানের বার্তাটি হলো It’s true Dr Momen and I have been friends for over 50 years now. But his writing a hasty DO to Railways Minister supporting the stand of the 5 other MPs of Sunamganj including a Jatio Party MP has taken me by surprise. He very well knows I am also an MP from Sunamganj. He knows this matter of rail connection with Sunamganj also concerns me. I know more about this issue than he. I don’t think he has ever set foot on Sunamganj soil in his long and colourful life. Any other person in this situation would have checked it with me before taking a side in this matter. For a friend of 50 years and a cabinet colleague, this would not be expected in normal condition. MAM.
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানও স্বীকার করেছেন তাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ৫০ বছরের বেশি সময়ের। তবে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যের সুনামগঞ্জের রেলপথের দাবিকে কেন্দ্র করে ডিও লেটার প্রদান তাকে অবাক করেছে বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন সুনামগঞ্জের রেললাইন সম্প্রসারণের বিষয়টি তার কাছেও গুরুত্বপূর্ণ এবং সংসদ সদস্য হওয়ার সুবাদে তার চেয়ে বেশি তিনি এ বিষয়ে অবগত। তিনি এ বিষয়ে আরও বিস্তর জানেন উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী নিজের বন্ধু পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি তার দীর্ঘ জীবনে সুনামগঞ্জের মাটিতে কখনো পা রেখেছেন। এই পরিস্থিতিতে পক্ষ নেওয়ার আগে বন্ধু হিসেবে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। ৫০ বছরের বন্ধু এবং মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে এটি অবশ্যই স্বাভাবিক নয়। এভাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান তার বন্ধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে উদ্দেশ্যে করে বার্তাটি লিখেছেন।
পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আমি শুরু থেকেই বলে আসছি যেদিকে সরকারের এক্সপার্টরা রেললাইন সম্প্রসারণ চাইবেন আমি মেনে নেবো। আমি তাদের মতামতকে মেনে নেব।
এ ব্যাপারে জানতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি কল রিসিভ করেননি।