হাওর ডেস্ক::
দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলাদেশি অভিবাসী মিজ এলিনোর রেমা বাংলাদেশের আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ায় আইন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ডিগ্রি সম্পন্ন করে তিনি এখন অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম বাংলাদেশি গারো আইনজীবী হওয়ার পথে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের এই নারী জন্মসূত্রে তিনি নেত্রকোণার বিরিশিরি এলাকার বাসিন্দা। তার বাবাও ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার বাসিন্দা।
এলিনোর তার পরিবারের সাথে ১৯৯৩ সালে পাঁচ বছর বয়সে বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। অস্ট্রেলিয়া তার বাড়ি হলেও বাংলাদেশ সর্বদাই তার মাতৃভূমি। তিনি বিশ্বাস করেন ন্যায়বিচার পেতে প্রত্যেকেরই সমান অধিকার এবং সুযোগ থাকা উচিত।
(কলেজে বন্ধুদের সঙ্গে এলিনর রেমা)
মিজ এলিনোর অস্ট্রেলিয়ায় তার বড় হওয়া এবং ক্যারিয়ার নিয়ে এসবিএস বাংলার সাথে কথা বলেছেন।
আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের মানুষেরা বাংলাদেশ ও ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে আছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারি ওয়েবসাইটগুলো থেকে দেখা যাচ্ছে মূলত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় ও বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় তাদের বাস।
তাছাড়া এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভারতে মেঘালয় ছাড়াও আসামের কামরূপ, গোয়ালপাড়া ও কারবি আংলং জেলায় এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ ছাড়াও টাঙ্গাইল, সিলেট, শেরপুর, নেত্রকোণা, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঢাকা ও গাজীপুর জেলায় বাস করে।
এলিনোর বলেন, তার পরিবারের সদস্যরাও ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ক্যানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ায় বাস করেন।
তবে তিনি জানান, অস্ট্রেলিয়ায় তার কমিউনিটির খুব বেশি মানুষ নেই, বিশ জনের কিছু বেশি হবে।
“আমার মায়ের পরিবার বাংলাদেশের উত্তরে ময়মনসিংহের বিরিশিরি অঞ্চলের, আমার নানা গারো সম্প্রদায় থেকে প্রথম কলেজ ডিগ্রী লাভ করেছিলেন, তিনি ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রী সম্পন্ন করে স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।”
নিজের বাবা সম্পর্কে এলিনোর বলেন, “আমার বাবা বাংলাদেশের ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার, এবং দাদা ছিলেন আমাদের সম্প্রদায়ের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।”
“আমার বাবা তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে টারশিয়ারি বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চ শিক্ষা লাভকারী প্রথম ব্যক্তি, তিনি বাংলাদেশে কৃষিবিজ্ঞানে অনার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করেন এবং সরকারি বৃত্তি নিয়ে ইংল্যান্ডে ও অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেন।”
এই অঞ্চলে বসবাসকারী গারো জাতির লোকদের প্রধান ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ‘ওয়ানগালা’।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি আমার বাবার কাছ থেকে ‘ওয়ানগালা’ উৎসব সম্পর্কে জেনেছি। উৎসবের এই দিনগুলোতে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানানো হয়, জমির ফসল ঘরে তোলা হয়। সবাই মিলে পানাহার এবং আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে।”
এলিনোর পাঁচ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ায় আসেন তার পিতামাতার সাথে। নিজের শৈশব জীবন সম্পর্কে তিনি বলেন, “অন্যান্য অভিবাসীদের মতোই আমার বাবা-মা কষ্ট করেছেন আমাদের দুবোনকে বড় করতে। তারা আমাদের আশ্রয় নিশ্চিত করা ছাড়াও একটি উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন দিতে চেয়েছেন।”
“আমার শৈশবটি ছিল খুব আদর্শমন্ডিত, অনেক বন্ধু-বান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের মাঝে অনেক আনন্দে বড় হয়েছি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল গুরুত্বপূর্ণ এবং বেড়ে ওঠার সময় নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকা আমার পড়াশোনার জন্য খুব কাজে লেগেছে।”
এলিনোর হাইস্কুল শেষ করে দর্শনে অনার্স ডিগ্রী সম্পন্ন করেন, মাইগ্র্যাশন আইনে গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা শেষ করে আইন বিষয়ে পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রী করছেন।
একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করতে গিয়ে তিনি অনুভব করেন যে সমাজের সকল নাগরিকদের, তারা যে সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থান থেকেই আসুক না কেন, দেশের বিদ্যমান আইনব্যবস্থা থেকে সমান সুযোগ পাওয়া উচিত।
যদিও অনেকদিন তার বাংলাদেশে যাওয়া হয় না, তবে এক সময় এলিনোর কয়েক বছর পরপরই বাংলাদেশে বেড়াতে যেতেন, যেখানে তার জ্ঞাতি ভাইবোন এবং নানা-নানী, দাদা-দাদীরা আছেন।
(বাঙালির সাজে এলিনর রেমা)
স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ঢাকার রাস্তায় ঘুরতে, খাওয়া দাওয়া করতে এবং বড় বড় শপিং মলগুলোতে কেনাকাটা করতে যেতে তিনি আনন্দ পান।
তাছাড়া তার গ্রাম বিরিশিরি এবং ধোবাউড়ার সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে এবং তাজা মাছ-তরিতরকারি স্বাদ নিতেও তার ভালো লাগে।
এলিনর পছন্দ করেন বাঙালি শাড়ি পড়তে। বিভিন্ন উৎসবে তাই তাকে বাঙালি নারী রূপে সাজতে দেখা যায়। তার এই কৃতীতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বসবাসতরত গারো সম্প্রদায়ের লোকজন উৎফুল্ল। তারা তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
(তথ্যসূত্র: sbs.com.au)