হাওর ডেস্ক::
বাংলাদেশের প্রায় ১৫ শতাংশ কভিড রোগী লং কোভিডে ভুগছেন। এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে এক গবেষণায়। বাংলাদেশের যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৭ জন গবেষকদের একটি দল লং কোভিড নিয়ে গবেষণা করেছেন।
এই গবেষণায় অংশ নেওয়া যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মো. ফিরোজ কবির জানান, ২০২০ সালের মে মাস থেকে শুরু করে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত এক বছর ধরে এই গবেষণা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশের দুই হাজারের বেশি কভিড রোগীর উপর গবেষণাটি করেছেন তারা। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৫ শতাংশ কোভিড রোগী লং কোভিডে ভুগছেন।
তিনি জানান, যুক্তরাজ্যে মোট আক্রান্ত কভিড রোগীদের মধ্যে এই হার বাংলাদেশের তুলনায় কম। সেখানে ১০ শতাংশের কিছু বেশি রোগীর মধ্যে লং কোভিডের উপসর্গ পাওয়া গেছে মাত্র।
তিনি লং কোভিডের বিভিন্ন উপসর্গ ব্যাখ্যা করে বলেন, এ ক্ষেত্রে, মাথাব্যথা, ভুলে যাওয়া, শরীর ব্যথা, দুর্বলতা, হৃৎস্পন্দনের ওঠানামার মতো উপসর্গ থাকে। আর এটি তিন মাস থেকে শুরু করে দেড় বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। হাসপাতালে দীর্ঘদিন ভেন্টিলেটারে থাকার পর তৈরি হতে পারে নানাধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতা
এদিকে, বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করে বলছেন, কভিড তো বটেই, নতুন করে উদ্বেগের বিষয় হতে যাচ্ছে লং কোভিড।
তারা বলছেন, কভিড পরবর্তী সময়েও নানা ধরনের শারীরিক জটিলতাই মূলত লং কোভিডের লক্ষণ আর বাংলাদেশে কোভিড আক্রান্তদের এক বড় অংশের মধ্যেই নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা গেছে।
‘নয় মাস ধরে অক্সিজেন নিয়েছি’
টেলিফোনে কথা বলার সময় এমন অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন নিলুফা আজাদী। বলছিলেন, গত বছরের অগাস্টের ১০ তারিখে কভিড পজিটিভ হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি।মূলত কোভিড আক্রান্ত স্বামীর সেবা করতে গিয়ে নিজেও আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি।
তার ফুসফুসের ৭৫ শতাংশ সংক্রমিত হয়েছিল। কিছুদিন পর পরীক্ষা করে তার কভিড নেগেটিভও আসে। তবে কভিড ভালো হলেও শুরু হয় নতুন ধরনের শারীরিক সমস্যা। কভিড পরবর্তী সময়েও দীর্ঘদিন ধরে তাকে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগতে হয়েছে। এমনকি কোভিডের পরেও টানা নয় মাস তাকে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন নিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘দু’মাস আগেও আমি অক্সিজেন নিয়েছি। অর্থাৎ প্রায় নয়মাস ধরে আমি অক্সিজেন নিয়েছি। আমার শরীর যা, ফুলে তার ডাবল হয়ে যায়। আমার হাঁটা-চলা বন্ধ হয়ে যায়। হাতে-পায়ে প্রতিটা জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যথা এখনো।’
‘গোছায় গোছায় চুল পড়ে গেছে’
চলতি বছরের মার্চে কভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন মইনুর সুলতানা। কভিড সেরে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন ধরে দুর্বলতায় ভুগেছেন তিনি। সাথে ছিল শরীরে ব্যথাও। মইনুর সুলতানা জানান, কভিডের পর তার মাথার বেশিরভাগ চুলই পড়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘গোছায় গোছায় এক গাদা করে চুল পড়েছে। এখনো পড়ছে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘ মেয়াদে লং কোভিড মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকরহয়ে উঠতে পারে।
কাদের ঝুঁকি বেশি?
গবেষক কবির জানান, কভিডের ক্ষেত্রে বলা হয় যে, যাদের বয়স বেশি কিংবা আগে থেকেই কোন ধরনের শারীরিক সমস্যা থাকে তাদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি বেশি। তবে তিনি বলেন, লং কোভিডের এই যুক্তি সবসময় খুব একটা কাজ করে না।
তাদের গবেষণা অনুযায়ী, মধ্যবয়সীদের মধ্যেই লং কোভিডের উপসর্গ বেশি পাওয়া যায়। ৩০ থেকে শুরু করে ৫৫ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের মধ্যে লং কোভিডে ভোগার প্রবণতা বেশি।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, আমাদের দেশে এই শ্রেণির মানুষই মূলত ‘ওয়ার্কিং ক্লাস’ অর্থাৎ এই বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে থাকে এবং অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। লং কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব তাই অর্থনীতিতেও পড়বে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি জানান, সাধারণত কভিড নারীদের তুলনায় পুরুষদের বেশি হয়, কিন্তু লং কোভিডের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। লং কোভিডে আক্রান্তের প্রবণতা পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে বেশি।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লং কভিড মানুষের শারীরিক ও মানসিক-দুই ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তারা বলছেন, কোভিড আক্রান্ত মানুষ সুস্থ হওয়ার অনেক দিন পর্যন্ত তার শরীরে নানা ধরনের শারীরিক অসুস্থতা থাকে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, লং কোভিডের কারণে মানুষের স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসময় তার ঘুম কম হতে পারে, মাঝে অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে যায় আবার অনেক সময় হতাশ হয়ে যায়। একে বলা হয় ভাবনার ওঠানামা।