হাওর ডেস্ক::
দেশে প্রসূতি ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের টিকা দেওয়া নিয়ে সংশয় ও বিভ্রান্তি চলছিল। সরকারের দিক থেকেও ছিল না কোনো নির্দেশনা। প্রসূতি বিশেষজ্ঞরা কিছুদিন ধরেই প্রসূতিদের করোনার টিকা দেওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন, পাশাপাশি প্রসূতিদের উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন। কিন্তু সরকারের নির্দেশনার অভাবে এতে তেমন কোনো সাড়া ছিল না। যদিও করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত দেড় বছরে অনেক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে।
সর্বশেষ সম্প্রতি একজন প্রসূতি চিকিৎসক ও একজন প্রসূতি বিচারকের করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পর প্রসূতিদের টিকার বিষয়টি আরো জোরালো হয়ে উঠেছে। বিষয়টি আদালতেও গড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অবশেষে দেশে গর্ভবতীদের করোনার টিকা দিতে সম্মতি দিয়েছে টিকাবিষয়ক সর্বোচ্চ পরামর্শক কমিটি বা ন্যাশনাল ইমুনাইজেশন অ্যাডভাইজারি গ্রুপ-নাইটেগ। গতকাল কমিটির এক বৈঠকে এসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যা আজ-কালের মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে জানানো হবে। এরপর সরকার এসংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করবে বলে জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
প্রসঙ্গত, এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে গর্ভবতী এবং সন্তানকে দুগ্ধদানকারী মায়েদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম দিকে বিষয়টি নিয়ে অধিকতর সতর্কতার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গ্রুপ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। তবে সম্প্রতি কয়েকটি দেশে গবেষণায় ইতিবাচক ফল পাওয়ায় ডাব্লিউএইচও এবং অন্যরা কিছু শর্তসাপেক্ষে এতে সায় দেয়। এ ক্ষেত্রে বলা হয়, গর্ভবতীতে টিকা দেওয়ার আগে তাঁকে টিকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত করতে হবে। তিনি সম্মতি দিলেই কেবল তাঁকে টিকা দেওয়া হবে।
নাইট্যাগের একজন সিনিয়র সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে দেশে গর্ভবতীদের টিকা দেওয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেব। এতে গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের কভিডের টিকা দিতে আর কোনো বাধা থাকবে না।’
অবস্ট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিটি মায়ের জানার অধিকার আছে টিকা দিলে কী প্রতিক্রিয়া হবে এবং বাচ্চার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে কি না। বিষয়টি তাঁদের জানাতে হবে। কেন টিকা দিতে হবে সেটা কাউন্সেলিং করতে হবে। যেহেতু এটি নতুন ভাইরাস, তাই সুদূরপ্রসারী কোনো স্টাডি নেই। তবে এখন পর্যন্ত টিকা নিলে বাচ্চা-মা ভালো থাকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। কোনো ক্ষতিকারক দিক প্রমাণিত হয়নি। যেসব মা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান তাঁদের ওপরও কোনো ক্ষতিকারক প্রভাব পড়েনি। বরং তাঁরা টিকা নিলে শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, সেটা বাচ্চার জন্যও উপকারী। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের টিকা দিতে হবে। সরকারকে এখন তাঁদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা নিশ্চিত করতে হবে।’
করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষার বিষয়ে এই প্রসূতি বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের প্রথম করণীয় হলো—গর্ভবতী মায়েদের ওপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া। গর্ভবতী মায়েরা কভিডে আক্রান্ত হয়ে যদি গর্ভকালীন জটিলতায় পড়ে যান, তাহলে তাঁর মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। পাশাপাশি ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশনের মতো রোগ যদি থাকে তখন হাসপাতালে ভর্তি করা জরুরি হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, গর্ভবতী মায়েদের আলাদা রুমে আইসোলশনে রাখতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যরা বাইরে থেকে এসে তাঁর সংস্পর্শে যেতে পারবে না। আর বাসায় যদি কভিড আক্রান্ত কেউ থাকে তাহলে তাকে মাস্ক পরে থাকতে হবে এবং একেবারে আইসোলেশনে থাকতে হবে। যদি কারো মধ্যে কভিডের লক্ষণও দেখা যায় তাকেও আলাদা থাকতে হবে। পাশাপাশি হাত ধোঁয়া, মাস্ক পরা, দূরত্ব মেনে চলতে হবে।’
ডা. সামিনা চৌধুরী জানান, গর্ভের প্রথম তিন মাস, মাঝের তিন মাস এবং শেষের তিন মাসে টিকা দিয়েছে এমন মায়েদের নিয়ে একটি গবেষণা হয়েছে। ‘প্রথম তিন মাসে যাঁরা টিকা নিয়েছেন তাঁদের এবরশন সংখ্যা অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের মতোই হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় তিন মাসে টিকা নিলে ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম থাকে। গর্ভকালীন শেষের তিন মাসে যদি কভিডে আক্রান্ত হন তাহলে মায়ের জন্য সেই সময়টা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়।’
সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘ফাইজার ও মর্ডানার গবেষণা বলছে, গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো ঝুঁকি নেই। ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতেও গর্ভবতী মায়েদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্স, স্পুিনক ভি টিকা দেওয়া যাবে বলে জানানো হয়েছে। কারণ এসব টিকার মধ্যে যে উপাদান আছে সেটা টিকা দেওয়ার পর শরীরের রোগ প্রতিরোধ সেল এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলে। টিকা নেওয়ার পর ইমিউনিটি বেড়ে যায়, অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এতে জীবাণু এলে আর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।’
ডাব্লিউএইচও বলছে, টিকা দেওয়ার আগে গর্ভবতী কি না সেটা টেস্ট করার কোনো দরকার নেই। এ জন্য মা ও বাচ্চাকে বাঁচানোর জন্য হলেও গর্ভবতী মায়েদের টিকা দিতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনোকোলজিস্ট বলছে, কোনো কোনো দেশে গর্ভবতী মায়েরা সম্মুখসারির যোদ্ধা। সেখানে তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি। রয়েল কলেজ অব অবসটেট্রিসিয়ানস অ্যান্ড গাইনোকোলজিস্ট বলছে, যেসব মায়ের ডায়বেটিস, ব্লাড প্রেশার আছে তাঁদের আরো আগে টিকা দিতে হবে। সাধারণ মানুষের মতোই গর্ভবতী মায়েদের টিকা দিতে হবে। অনেকে বলছে, প্রথম তিন মাস বাদ দিতে। কিন্তু গবেষণা বলছে, গর্ভকালীন যেকোনো সময় ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে।
এদিকে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার টিকা দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে গতকাল হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের চার আইনজীবী ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির পল্লব, ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাউছার, অ্যাডভোকেট রাশিদা চৌধুরী ও ব্যারিস্টার মোজ্জাম্মেল হক জনস্বার্থে এই রিট আবেদন করেছেন। আবেদনকারীদের মধ্যে রাশিদা চৌধুরী নিজেই অন্তঃসত্ত্বা। আবেদনে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, মন্ত্রিপরিষদসচিব, স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং আইইডিসিআরের পরিচালককে বিবাদী করা হয়েছে।
এর আগে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার টিকা দিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে গত ২৯ জুলাই সরকারকে আইনি নোটিশ দেওয়া হয়। মানবাধিকার সংঠন ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির পল্লব ও ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাউছার এই নোটিশ দেন।
গতকালের রিট আবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে অন্তঃসত্ত্বাদের করোনা টিকা দেওয়া যাবে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অন্তঃসত্ত্বাদের ফাইজার ও মডার্নার টিকা দেওয়া হচ্ছে। টিকা নেওয়া অন্তঃসত্ত্বাদের মধ্যে তেমন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বরং গবেষণার তথ্যানুযায়ী, অন্তঃসত্ত্বা নারীরা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার অধিক ঝুঁকির মধ্যে থাকেন।