সুখেন্দু সেন::
“মেরা মন দোলে,মেরা তন দোলে-
মেরি দিলকা গ্যায়া কেরার রে-
ইয়ে কৌন বাজায়ে বাঁশরিয়া—”
পঞ্চাশের দশকে নির্মিত জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা “নাগিন” সুনামগঞ্জের দিলরুবা সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছিল গত শতকের ষাট বা একষট্টি সনে।বৈজয়ন্তী মালা-প্রদীপ কুমার অভিনীত এবং লতা মুঙ্গেশকর,হেমন্ত মুখার্জির গানে গানে আলোড়ন তোলা সিনেমাটি আমার দেখা প্রথম সিনেমা। তবে না দেখেই। সিনেমা শুরুর প্রথমেই নাগিনীর নাচা নাচিতে ভয়ে বন্ধ করা চোখে ঘুম চেপে বসেছিলো। নিদ্রা ভঙ্গ হলো সামনের দিকের দর্শকদের হৈচৈ আর বিচিত্র শব্দে সিটি বাজানোর কোলা হলে।ততক্ষনে সিনেমা শেষ।সবাই দাড়িয়ে পড়েছে।পর্দায় চাঁদতারা পতাকার সাথে পাক্ সার্ জামিন্ সাদ্ বাদ্ কেবলি আমার দেখা আর শুনার জন্য বাকী রইলো।পরবর্তী সময়ে এ ছবির গানগুলি প্রায় দু’দশক শ্রোতাদের মন প্রান দুলিয়েছে,পুরনো গানগুলি এখনও তেমনি দোলায়।
সে সময়ে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল সিনেমা। হলে গিয়ে দেখতে হতো। সে সুযোগ সচরাচর মিলতো না। আমাদের যৌথ পরিবারে বোনদের সংখ্যাই ছিলো বেশী।দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য বশতঃ সবাই আমার বড়।প্রতি বছর এক একজনের বিয়ে।ফিরা-যাত্রায় নুতন জামাইয়ের কাছে শালাশালীদের আব্দার বা দাবি- জাম্বু, সিনেমা দেখাতে হবে। নুতন জামাইরা তেমনি প্রস্তত থাকতেন।সানন্দেই রাজী হতেন। সিনেমায় যাওয়ার অনুমতিও মিলতো। সে সুযোগে বড়রাও সঙ্গ নিতেন।বুঝি না বুঝি সর্বকনিষ্ঠ আমিও সে দলে অন্তর্ভুক্ত হতাম।
কলেজ জীবনে বা পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু সিনেমা দেখা হয়েছে।বন্ধু বান্ধবদের অনেকই ছিল সিনেমা পাগল ।স্কুলের অনেক সহপাঠি শনিবার,বুধবারে স্কুল পালিয়ে ম্যাটিনী শো দেখে এসে সিনেমার সরস গল্প শুনিয়ে আমাদের কৃতার্থ করতেন।স্কুলের গন্ডিতেই দু’একজন আবার মুহাম্মদ আলী,ওয়াহিদ মুরাদের চুলের স্টাইল,হাটাচলার কায়দা রপ্ত করে নিজের মনেই নিজে হিরো হয়ে তৃপ্তি পেতেন। কেনো জানি বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ধরে নি। একটু চিন্তাভাবনা করলে জীবনে দেখা সকল সিনেমার নাম বলে দিতে পারব। সেটি স্মৃতিশক্তির প্রখরতার জন্য নয়,সংখ্যা স্বল্পতার কারনে।
সুনামগঞ্জের একমাত্র সিনেমাহল দিলরুবা নাম পরিবর্তন করে নূরজাহান হয়েছিল ষাটের দশকের প্রথম দিকে। নূরজাহান সিনেমায় আমার দেখা শেষ সিনেমা সূর্যকন্যা সম্ভবত ৭৭/৭৮সালে। তাও অপ্রত্যাশিত ভাবে দলবেধে ম্যাটিনি শো দেখার সুযোগ পেয়ে।বুলবুল আহমদ-জয়শ্রী অভিনিত ছবিটিতে সন্ধ্যা মুখার্জীর কন্ঠে, আমি যে আঁধারে বন্দিনী,আমাকে আলোতে ডেকে নাও গানটি আমার প্রিয় গানগুলির একটি।
ধান বানতে শিবের গীত। আমার সিনেমা দেখার স্মৃতি বিস্মৃতি আজকের লেখার উদ্দেশ্য নয়। প্রসঙ্গটি ভিন্ন। তখনকার সময়ে বিনোদনের প্রধান মাধ্যমটির প্রচার প্রচারনাও চলতো জোরেশোরে। ডিমাই সাইজের কয়েকটি সিনেমা সাপ্তাহিক,গ্রন্থাকারের সিনে মাসিকগুলি জমজমাট সিনেমা সংক্রান্ত এবং নায়ক নায়িকাদের রমরমা খবরে। ভরপুর রঙ্গিন ছবিতে। তখনও ব্যানার পোস্টারের ডিজিটাল পদ্ধতি আবিষ্কার হয়নি। কাগজের রঙ্গিন পোস্টার,কাপড়ের তৈরী সুদৃশ্য বিশাল ব্যনারে ছবির আকর্ষনীয় বিজ্ঞাপন। রাজধানীসহ মফস্বল শহরগুলি সয়লাব হয়ে যেতো। বিশেষ করে ঈদের মওশুমে তার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটতো।প্রতি ঈদেই নুতন নুতন ছবি মুক্তি পেতো। নির্মাতাদের প্রতিযোগিতাও থাকতো ঈদের ছবি নিয়ে। দর্শকদেরও আগ্রহ। ঈদ উপলক্ষে প্রচার প্রচারনাতেও যোগ হতো ভিন্ন মাত্রা।
শহরের একমাত্র সিনেমা হল নূরজাহানেও ঈদে নুতন ছবি আসতো। শহরের দেয়ালে দেয়ালে,চায়ের দোকানে,সেলুনে রঙ্গিন পোস্টার।চাটাই বাঁশের ফ্রেমে কাগজের পোস্টার সেটে তা ঝুলিয়ে রাখা হতো গাছে কিংবা লাইটপোস্টে।নায়ক নায়িকা,অভিনেতা অভিনেত্রীদের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির আকর্ষণীয় ছবি। পোস্টার দেখে অভিজ্ঞরা বুঝে নিতো কোনটি রোমান্টিক বা কোনটি এ্যকশন ছবি।সিনেমা পাগল দর্শকরা পোস্টারে প্রিয় অভিনেতা অভিনেত্রীদের দারুন দারুন সব পোজ দেখে হুমড়ি খেয়ে পড়তো সিনেমা হলে। হাউস ফুল।
সিনেমার সে রমরমা দিন আর নেই।ঈদে নুতন ছবি তৈরী হয় কিনা তা নিয়ে কারো তেমন কোন আগ্রহও দেখা যায় না। সুনামগঞ্জে সিনেমা হলই এখন আর নেই। সিনেমার পোস্টারও তাই চোখে পড়ে না। তাই বলে ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল পোস্টারের অভাব নেই। অভিনেতা অভিনেত্রীর স্থান দখল করে নিয়েছেন এখন রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা। সারা বছরই রাজনৈতিক পন্যের বিজ্ঞাপণ হয়ে ঝুলে থাকেন লাইটপোস্টে কিংবা গাছের ডালে। শহর সয়লাব হয়ে থাকে জঞ্জালের মত। পাই নেতা থেকে শুরু করে আনি নেতা,সিকিনেতা,পাতিনেতা,উপনেতা,বিদ্রোহী নেতা সকলেরই এমন পোস্টার ঝুলানো চাই।তাতে আবার নিজ ঘরানার সকল নেতা,স্থানীয় নেতা,আঞ্চলিক নেতা,জাতীয় নেতা,দলীয় প্রধান দের ছবি সংযুক্ত। কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতির সফর উপলক্ষে পরিচ্ছন্নতা অভিযানে ব্যানার পোস্টারগুলি সরিয়ে জঞ্জাল মুক্ত করা হয়েছিলো। শহরের পরিবেশটাই কেমন বদলে গিয়ে পরিচ্ছন্ন খোলামেলা মনে হতো। আবার লাগানো শুরু হয়েছে।আশা করা যায় ঈদের আগেই হাউস ফুল হয়ে যাবে।