বিশেষ প্রতিনিধি::
বেলা দুপুর ১২টা। সুনামগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল কক্ষের দক্ষিণ দিকে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে আছে ৭০জন কোমলমতি শিশু-কিশোর। সঙ্গে অভিভাবকরাও। আদালতের এজলাসে সাধারণ পোশাক পড়ে আসীন হলেন বিচারক মো. জাকির হোসেন। তার সামনে বসা আইনজীবীরা। চেয়ারে বসেই তিনি বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত শিশুদের উদ্দেশ্যে গঠনমূলক বক্তব্য দিলেন। ৫০টি মামলার অভিযুক্ত ৭০জন শিশু-কিশোরকে কারাগারে না পাঠিয়ে ৯টি শর্তে তিনি তাদেরকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠের বদলে মা বাবার জিম্মায় সংশোধনের জন্য পাঠানোর আদেশ দেন। আদালতের পক্ষ থেকে তাদের হাতে তুলে দেন ফুল, জাতীয় পতাকা, কলম ও ডায়েরি। জাতীয় পতাকা ও ফুল কেন দেওয়া হলো বিচারক সেই কারণও ব্যাখ্যা করেন। আদালতে কেন বিচারকের পোষাকে না এসে সাধারণ পোষাকে আসলেন তার কারণও ব্যাখা করলেন।
বিচারকের আসনে বসে রায় ঘোষণার পর সুনামগঞ্জ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন প্রবেশনে মা বাবার জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া শিশুদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমাদেরকে ফুল দিয়ে বরণ করার কারণ হলো তোমরা যাতে নিষ্পাপ ফুলের মতো বিকশিত হও। সমাজের মঙ্গল করো, সুবাস ছড়াও। স্বাধীনতার মাসে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়ার কারণ হলো, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশপ্রেমকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে যেতে জাতীয় পতাকা হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। তাই তোমাদেরকে দেশপ্রেমে বলিয়ান হয়ে প্রকৃত মানুষ হতে হবে। বাংলাদেশকে সব সময় বুকে ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন চিন্তা কখনো করা যাবেনা। সবসময় বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করে স্বাধীনতার অর্জনকে বাস্তবায়ন করতে হবে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্যে বিচারক আরো বলেন, এটা স্বাধীনতার মাস। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, তিরিশ লাখ শহিদদের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীনতার জন্য তোমাদের বয়সী অনেকে শহিদ হয়েছেন, পঙ্গু হয়ে এখনো বেঁচে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের এই ইতিহাস তোমাদের জানতে হবে। তোমাদের বয়সীরা যুদ্ধ করেছেন। তোমাদের চেয়ে আরো কম বয়সীরা মুক্তিযোদ্ধাদের সোর্স হয়েছিলেন, খাবার এগিয়ে দিতেন, খবর এনে দিতেন। তাই তোমরা আগামীতে জজ, ব্যারিস্টার, উকিল, সাংবাদিক, শিক্ষক যাই হও আগে প্রকৃত মানুষ হতে হবে। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস জানতে হবে। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস না জানলে দেশের প্রতি মায়া জন্মাবেনা। বিচারক এভাবেই রায়ের পরে কোমলমিত শিশু কিশোরদের দেশপ্রেমিক ও প্রকৃত মানুষ হওয়ার আহ্বান জানান।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে প্রায় দুই বছরে আদালতে শিশু কিশোর অপরাধের ৫০টি মামলা বিচারের জন্য আসে। এই মামলা গুলোতে পরিবারের বড়োদের সঙ্গে শিশুদেরও অভিযুক্ত করে প্রতিপক্ষের লোকজন। পরিবারের সঙ্গে কোমলমতি শিশু-কিশোররা আদালতে এসে হাজিরা দিতো। এতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল তারা। তাদের শিক্ষা জীবন ও স্বাভাবিক বিকাশও ব্যহত হচ্ছিল। আদালতের বিচারক মো. জাকির হোসেন এই বিষয়টি লক্ষ্য করে চতুর্থবারের মতো তিনি শিশুদের এই মামলা গুলো আপসে নিষ্পত্তি করে প্রবেশনে শিশুদের মুক্তি দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলে শিশুদেরকে মা বাবার সঙ্গে বসবাসের মাধ্যমে শিক্ষা জীবন ও স্বাভাবিক জীবন যাতে ব্যাহত না হয় সেই উদ্যোগ নেন। এভাবেই তিনি ৫০টি মামলায় ৭০জন শিশু-কিশোরকে মা বাবার জিম্মায় ৯টি শর্ত দিয়ে প্রবেশনে মুক্তি দেন।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তাকে প্রতি তিনমাস অন্তর অন্তর শিশুদের সম্পর্কে আদালতকে অবগতির নির্দেশনা দিয়ে তাদেরকে প্রবেশনে মুক্তির ব্যবস্থা করেন। এর আগে আরো তিন দফা ৯৫টি মামলায় ১৩৩ জন শিশুকে একইভাবে প্রবেশন দিয়ে মামলা থেকে নিষ্কৃতির মাধ্যমে মা বাবার কাছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বিচারক মো. জাকির হোসেন। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন সময়ে ১৫০ জন দম্পতিকে আবারো সংসারে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আদালতের এই রায়কে অভিনন্দন জানিয়েছেন অভিভাবক ও আইনজীবীরা।
প্রবেশনে মুক্তি পাওয়া জগন্নাথপুর উপজেরা সাদীপুর গ্রামের এইসএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র কামরুল ইসলাম বলেন, আমি ও আমার দুই ফুফাতো ভাই কলেজে থেকেও বাড়িতে তুচ্চ বিষয়ের একটি মামলায় আসামি হয়েছিলাম। আমরা স্বজনদের সঙ্গে আদালতে আসতাম। খুব খারাপ লাগতো হাজিরা দিতে। আমার পড়ালেখা ব্যাহত হতো। আজ মাননীয় বিচারক আমাদের প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছেন। আমরা আদালতের রায়ে খুশি। আদালত যে শর্ত গুলো দিয়েছে আমরা তা মেনে একজন ভালো মানুষ হয়ে ওঠতে চাই। একই মামলার অভিযুক্ত শিশু ও এসএসসি পরীক্ষার্থী আকমল উদ্দিন বলেন, আমরা আজ খুশি। আমাদের আতœীয়-স্বজনও খুশি ও আদালতের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন থেকে মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতে পারবো। আর কোন দুশ্চিন্তা নেই।
দিরাই উপজেলার দক্ষিণ সুরিয়ারপাড় গ্রামের বাসিন্দা ও অভিযুক্ত শিশুর পিতা মুক্তার আলী বলেন, আমার ছেলে ও আমি খুব খুশি। আমার ছেলে যাতে ভালো হয়ে চলাফেরা করতে পারে এবং সমাজের ভালো মানুষ হয়ে ওঠে তার জন্য সবার দোয়া চাই।
জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা মো. শফিউর রহমান বলেন, আদালত এক বছরের জন্য প্রবেশনে মা বাবার জিম্মায় শিশুদের মুক্তি দিয়েছেন। আমরা তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবো এবং তাদেরকে শর্তগুলো মানাসহ নানাভাবে সহযোগিতা করবো।
সুনামগঞ্জ শিশু আদালতের পিপি এডভোকেট হাসান মাহবুব সাদী বলেন, আদালতের ৯টি শর্ত হলো, নিয়মিত পড়াশুনার পাশাপাশি প্রতিদিনের ভালো কাজ বিচারক প্রদত্ত ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানা, সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে ভালো ব্যবহার, বাবা-মাসহ গুরুজনদের আদেশ মেনে চলা, তাদের সেবা যতœ করা ও কাজে কর্মে সহযোগিতা করা, নিয়মিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ ও ধর্মকর্ম পালন করা, ২০টি করে গাছ লাগিয়ে পরিচর্চা করা, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা, মাদক থেকে দূরে থাকা এবং ভবিষ্যতে কোন অপরাধের সাথে নিজেকে না জড়ানো। এই শর্ত গুলো মানার জন্য জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা মো. শফিউর রহমানকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি পর্যবেক্ষণ করে প্রতি তিন মাস পরপর আদালতকে শিশুদের বিষয়ে অবহিত করবেন।