হাওর ডেস্ক ::
হাওরের কৃষকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর হচ্ছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আবহাওয়া পূর্বাভাস ও সকর্তীকরণ কেন্দ্রের এক সপ্তাহের পানি বৃদ্ধির পূর্বাভাস শেষ হচ্ছে আজ রবিবার। এর মধ্যেই গতকাল শনিবার এলো অকালবন্যার ঝুঁকির পূর্বাভাস।
এদিকে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে শুক্রবার রাতে ফসল রক্ষা বাঁধে আবারও ফাটল দেখা দেয়।
কৃষকদের তৎপরতায় তাৎক্ষণিকভাবে ভাঙন সাময়িক ঠেকানো গেছে। কিশোরগঞ্জে নদ-নদীর পানি বাড়ায় কয়েকটি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধও হুমকির মুখে। কৃষকদের নিয়ে প্রশাসন সেসব বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে। সেখানে আগাম জাতের ব্রি-২৮ ও হাইব্রিড ধান কাটা প্রায় ২৪ শতাংশ হয়ে গেছে। মূল হাওরগুলোতে ধান না পাকায় এখনো ৭৬ শতাংশ কাটা-মাড়াই শুরু হয়নি।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ভারতের মেঘালয় ও আসামে ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবারও দ্বিতীয় দফা পাহাড়ি ঢল বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওরের বোরো ফসল নিয়ে চরম ঝুঁকিতে পড়েছেন কৃষকরা। এখন ধান কিছু পেকে যাওয়ার কারণে কৃষকরা হাওরে চলে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোর কাজে শ্রমিকও মিলছে না। ফলে পাউবো চিহ্নিত অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ৮০টি বাঁধ চরম ঝুঁকিতে। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা কৃষকদের।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, জেলায় ৪০ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। তবে এখনো এক লাখ ৮১ হাজার ৮২৮ হেক্টর জমির ধান কাটা বাকি আছে। আজ রবিবার থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজার হেক্টর জমির ধান কাটার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। এই মাসের মধ্যেই ৯০ শতাংশ ধান কাটা শেষ হবে।
গতকাল দুপুরে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক হাওরের কৃষকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে কৃষকদের উৎকণ্ঠার বিষয়ে বলেন, যেভাবে পানি বাড়ছে, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার চাপতির হাওরের মতো হাওরগুলোর ফসল তলিয়ে যেতে পারে। আর তা হলে সারা দেশে খাদ্যমূল্যে প্রভাব পড়বে। তাই দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দেন তিনি।
কিশোরগঞ্জের হাওরের কৃষকরা জানান, আরো অন্তত দুই সপ্তাহ পর ব্রি-২৯ ও ব্রি-৮৯ জাতের ধান কাটার উপযুক্ত হবে। সে সময় পর্যন্ত অকালবন্যার কবল থেকে ফসল টেকানো নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন তাঁরা। হাওরে ধান কাটার শ্রমিকের সংকটও আছে। তবে কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, বিগত দুই বছর সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্ষেতমজুর আনা হলেও এবার সেই পরিকল্পনা নেই।
পাউবো কর্মকর্তা ও স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, পানি বাড়তে থাকায় হাওরের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের অন্তত ১০টি বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে।
কিশোরগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মতিউর রহমান জানান, সুনামগঞ্জের পর নেত্রকোনা জেলার নদ-নদীর পানি গতকাল বিপত্সীমা অতিক্রম করেছে। এই হারে পানি বাড়লে আজ সন্ধ্যা নাগাদ কিশোরগঞ্জের নদ-নদীর পানি বিপত্সীমা অতিক্রম করতে পারে। তাতে বেশ কয়েকটি হাওর ঝুঁকিতে পড়বে।
কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে হাওরে মাইকিং করে ৮০ শতাংশ পাকতেই ধান কেটে ফেলার আহবান জানানো হচ্ছে। তবে হাওরে কৃষি শ্রমিক তথা ক্ষেতমজুরের সংকটের আশঙ্কা করছেন সাধারণ কৃষকরা। তবে কৃষি বিভাগ দাবি করছে, ধান কাটা পুরোদমে শুরু হলে শ্রমিকের সংকট বা শ্রমিকের জন্য হাহাকার পড়বে না। এবার কিশোরগঞ্জের হাওরে সরকারের ৭০ শতাংশ ভর্তুকি মূল্যের ৩২২টি কম্বাইন হার্ভেস্টার ও রিপার দেওয়া হয়েছে।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, এবার জেলায় এক লাখ ৬৭ হাজার ১৯৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওর এলাকায় আবাদ করা হয়েছে এক লাখ তিন হাজার ৯৪০ হেক্টর জমি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. ছাইফুল আলম জানান, হাওরের কৃষকরা আগে থেকে সচেতন হয়েছেন। ফলে ফসল হারানোর ভয়ে তাঁরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পাকতেই ধান কাটতে শুরু করেছেন।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম জানান, অকালবন্যার কবল থেকে হাওর রক্ষায় কৃষক ও প্রশাসন থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরা মিলে বাঁধ পাহারা দিচ্ছেন।
জগন্নাথপুরে হাওরের ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধে শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ফাটল দেখা দিলে স্থানীয় মসজিদের মাইকে তা রক্ষার আহবান জানানো হয়। আশপাশের গ্রামের লোকজন গিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা চালায়।
কৃষক ও পাউবো সূত্র জানায়, উপজেলার কলকলিয়া ইউনিয়নের গোড়ারগাঁও গ্রামের পাশে গোড়ারগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনের হাওরের ফসল রক্ষার ওই বাঁধ এলাকাবাসীর চেষ্টায় রক্ষা পেয়েছে।
নাদামপুর গ্রামের বাসিন্দা কলকলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য সাজাদ মিয়া বলেন, এর আগে পর পর দুইবার ওই বেড়িবাঁধ ধসের ঘটনা ঘটে। কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে নিজেদের অর্থ ব্যয় করে বাঁধ রক্ষা করেছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধটি টেকসই করতে কোনো ভূমিকা রাখেনি।
ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ কমিটির সভাপতি অর্জুন দাশ বলেন, ‘সাতটি স্পটে বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। শুধু ওই স্পটে বারবার ধসের ঘটনা ঘটছে। প্রকল্প কমিটির সভাপতি হিসেবে প্রাক্কলন অনুযায়ী কাজ শেষ করেছি। এখনো এলাকাবাসীকে নিয়ে বাঁধ রক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। ’ সূত্র : কালের কণ্ঠ