বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার এক তালিকাভূক্ত রাজাকারের মুক্তিযোদ্ধার সনদ ও গেজেট বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তানসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন। এই দাবিতে রবিবার দুপুরে জেলা শহরে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দিয়েছেন। রাজাকারের সনদ ও গেজেট বাতিল না হলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মৃত্যুপরবর্তী সরকারের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা না নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
মানববন্ধন পরবর্তী বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর প্রতীক ইদরিস আলী, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমা-ার হাজি নূরুল মোমেন, সাবেক ডেপুটি কমা-ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমা-ার আব্দুল মজিদ, দোয়রাবাজার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমা-ার সফর আলী প্রমুখ। বিক্ষোভ সমাবেশে প্রায় ২শ বীর মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেন।
মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল পরবর্তী সমাবেশ ও সাংবাদিকদের সরবরাহকৃত আবেদনে বীর মুক্তিযোদ্ধারা উল্লেখ করেন, দোয়রাবাজার উপজেলার সদর ইউনিয়নের বীরসিং গ্রামের গোলাম ফকিরের ছেলে আলা উদ্দিন একাত্তরে একজন রাজাকার ছিলেন। তার নেতৃত্বে এলাকায় পাকিস্তানিরা গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চলে। স্বাধীনতার পর গা ঢাকা দিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যান আলা উদ্দিন। ১৯৭৫ সনের পর এলাকায় ফিরে আসেন। ১৯৭২ সনে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৮১ সনে তার চাকুরি চলে যায়। ২০০৫ সনের ২৫ এপ্রিল বিএনপি সরকারের আমলে সেনা মুক্তিযোদ্ধা গেজেটে ১৫৮৫ নং ক্রমকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গোপনে নাম অন্তর্ভূক্তি করিয়ে নেন। কাজটি গোপনে করায় এলাকার কোন বীর মুক্তিযোদ্ধা এসব বিষয় জানতেন না। ২০১২ সনের ১৪ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাময়িক সনদ নিয়ে আসার পর এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিষয়ট অবগত হন। এই ঘটনা জানাজানি হলে বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন। পরে ২০১২ সনের ১১ নভেম্বর আলা উদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা গেজেট ও সনদ বাতিলের দাবিতে লিখিত আবেদন করেন তারা। এর মধ্যে ২০১৩ সনে তার নামে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বরাদ্দ হওয়ায় উপজেলার সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দাবির প্রেক্ষিতে তার ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ঘটনার পর দোয়ারাবাজার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলে আলা উদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়ে আলা উদ্দিন ভাতার দাবিতে ২০১৫ সনে সহকারি জজ আদালতে স্বত্ত মামলা দায়ের করেন। মামলা চলাকালে ২০১৬ সনে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে আলা উদ্দিনকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়নি প্রশাসন। ২০২০ সনে আদালত আলা উদ্দিনকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতার নির্দেশনা দেয়। এ ঘটনায় সরকারের পক্ষে উপজেলা সমাজসেবা অফিসার আপিল করেন। আলা উদ্দিনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিল না হওয়ায় জজ কোর্ট নি¤œ আদালতের রায় বহাল রাখেন পরবর্তীতে। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ জারি রাখেন। সনদ ও গেটেজ বাতিলের দাবিতে অটল থাকেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানান, ২০১২ সনে বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু রচিত রক্তাক্ত একাত্তর বইয়ে ১৯০ নম্বর পৃষ্ঠায় ৩৪ নম্বর ক্রমিকে রাজাকারের তালিকায় আলা উদ্দিনের নাম আছে। ২০১৭ সনে আলা উদ্দিনের পুত্র উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাছাই বাছাই কমিটিতে তার বাবার মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত বিষয়ে আবেদন করলে তার পক্ষে উপজেলার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও স্বাক্ষী দেনননি। পরে যাছাই বাছাই কমিটি আলা উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা নন বলে সিদ্ধান্ত নেন।
আলা উদ্দিনের গেজেট ও সনদ বাতিলের দাবিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী বরাবর দোয়ারাবাজার উপজেলার সদর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমা-ার প্রবীর চন্দ্র সরকার জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে ২০২০ সনের ১৭ নভেম্বর লিখিত আবেদন করেন। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ২০২১ সনের ২৫ জানুয়ারি ও একই সনের ২৮ আগস্ট দুই দফায় নোট লিখে জামুকায় পাঠান। সর্বশেষ গত ১৩ জুন অভিযোগকারীকে নির্দিষ্ট একটি ফরম দিলে অভিযোগকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রবীর চন্দ্র সরকার তাৎক্ষণিক তা পূরণ করে জমা দিলেও জামুকা কোন শুনানী ও বা তদন্ত না করে জামুকার গত ২৪ মে ৫৫৩ নং স্মারকের অভিযোগকারী বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাতা তিন মাসের জন্য স্থগিত এবং আলা উদ্দিনের ভাতা প্রদানের আদেশ দেয়। জামুকার এই ঘোষনা ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন উপজেলার সর্বস্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাৎক্ষণিক তারা বিক্ষোভ মিছিল, প্রতিবাদ করে আলা উদ্দিনের বাড়িতে থুথু কর্মসূচি পালন করেন। গত সপ্তাহে দোয়ারাবাজার উপজেলার সর্বস্তরের মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ সমাবেশ করে আলা উদ্দিনের গেজেট ও সনদ বাতিল না হলে মৃত্যুর পর সরকারের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বর্জনের ঘোষণা দেন।
দোয়ারাবাজার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমা-ার মো. সফর আলী বলেন, স্বাধীনতার পর রাজাকার আলা উদ্দিন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। ৭৫ সনের পর ফিরে আসে। বিএনপির আমলে মুক্তিযোদ্ধা বনে যায়। এলাকার সবাই তাকে রাজাকার হিসেবে চিনে। তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও গেজেট বাতিলের দাবিতে আমরা বিভিন্ন স্থানে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। অচিরেই যদি বাতিল না হয় তাহলে আমরা মৃত্যুর পর সরকারি রাষ্ট্রীয় সম্মান বর্জন করব।
স্মারকলিপি প্রদান করতে আসা সেলা সাবসেক্টরের কম্পানি কমা-ার বীরপ্রতীক ইদরিস আলী বলেন, আলা উদ্দিন একজন কুখ্যাত রাজাকার। সে মুক্তিযোদ্ধা গেজেট ও সনদ নিয়ে আসায় আমরা বিব্রত ও লজ্জিত। অবিলম্বে তার গেজেট ও সনদ বাতিল করতে হবে।