এ বছর থেকেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। সরকার ইতোমধ্যেই মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় তিন লাখের বেশি শিক্ষককে নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। নতুন এ শিক্ষাক্রমে শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
প্রথমে দেখা যাক কি আছে এই নতুন শিক্ষাক্রমে। বলা হচ্ছে নতুন এ শিক্ষাক্রমটি ২০১৭ সাল থেকে গবেষণার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেছে দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, এনসিটিবির দক্ষ গবেষকবৃন্দ, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকগণ।
এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পিছনে যেসব কারণ দেখানো হয়েছে তা হলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় মানুুষের জীবন জীবিকার দ্রুত পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের ফলে মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত অনেক পেশার তিন ভাগের দুই ভাগ ২০৩০ সালের মধ্যে অবলুপ্ত হয়ে যাবে এবং ৬৫ % শিক্ষার্থী যারা এখনো প্রাথমিক শিক্ষায় আছে তারা কর্মজগতে প্রবেশ করে যে কাজ করবে তা এখনো অজানা । তাছাড়া কোভিডের মতো মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার,এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন প্রভৃতি কারণেও শিক্ষা পদ্ধতি পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক, অভিযোজনে সক্ষম বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে শিক্ষা ব্যবস্থায় এ পরিবর্তন আনতে হয়েছে। উন্নত ৫১ টি দেশে ইতোমধ্যেই তাদের শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন সাধন করেছে।
নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ যা ২০২২ সাল থেকে বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও কোভিড ১৯ এর কারণে একবছর পিছিয়ে ২০২৩ সাল থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এবছর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে । ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ অষ্টম ও নবম শ্রেণি এবং ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণি এই শিক্ষাক্রমের আওতায় নিয়ে আসবে সরকার। পরবর্তীতে ২০২৬ সালে একাদশ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে।
এই শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাক প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি যোগ্যাতা নির্ধারণ করা হয়েছে। যার ভিত্তি ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান,দক্ষতা,মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতা। এ ব্যবস্থায় প্রাথমিকে ৮টি ও মাধ্যমিকে ১০টি এবং উচ্চ মাধ্যমিকে আবশ্যিক ৩টি নৈর্বাচনিক ৩টি ও প্রায়োগিক ১টি বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে। দশম শ্রেনি পর্যন্ত কোন বিভাগ (মানবিক,বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা) থাকবে না। শিখন শেখানো কৌশল হবে প্রেক্ষাপট ও অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। মাধ্যমিক শেষে প্রত্যেক শিক্ষার্থী কৃষি, সেবা বা শিল্প খাতের একটি পেশায় দক্ষতা অর্জন করবে। সকল ধরণের শিখন মূল্যায়নের ভিত্তি হবে যোগ্যতা ও পারদর্শিতা। যা শিখনকালীন ও সামষ্টিক এই দুইভাবে মূল্যায়ন করা হবে। শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে বছরব্যাপী। সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক। মূল্যায়নের পারদর্শিতার মানদন্ড নির্ধারণ করা হবে তিনটি ক্ষেত্রে। যথা-প্রারম্ভিক, অন্তর্র্বতীকালীন ও পারদর্শী।
১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে সংবিধানের জাতীয় চারমূলনীতির উপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদার নেতৃত্বে দেশের প্রথম শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। এটি ছিল একমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক ও একই ধারার শিক্ষানীতি। এই শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ছিল দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞান মনস্ক, মানবিক গুণসম্পন্ন বিশ্বনাগরিক গড়ে তোলা। ৭৫’র পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেই প্রত্যাশিত আধুনিক শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের মুখ দেখতে পারে নি। পরবর্তীতে স্বাধীনতার চার দশক পর ২০১০ সালে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড.কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল সেই শিক্ষানীতিই বর্তমানে চলছে। এই শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হলো দেশপ্রেমিক, বিজ্ঞান মনস্ক, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক গুন সম্পন্ন কর্মদক্ষ বিশ্বনাগরিক গড়ে তোলা।
মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ দশক অতিক্রম করলেও দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন হবে বলে মনে করছেন শিক্ষাক্রমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
সভ্যতা বিনির্মাণের প্রথম চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। যে দেশ যত বেশি শিক্ষিত সে দেশ তত বেশি উন্নত। যে কোন দেশ উন্নয়নের প্রথম শর্তই হচ্ছে ঐ দেশের শিক্ষা কাঠামোর উন্নয়ন। আর এসব কিছুর পিছনে কাজ করেন শিক্ষক সমাজ। তাই শিক্ষককে অবশ্যই সর্বোচ্চ মেধার অধিকারী হতে হবে। শিক্ষক সমাজে মেধাবী লোকদের নিয়োগ করতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন শিক্ষক সমাজের যথোপযুক্ত সম্মান। জগতের সকল উন্নত দেশেই শিক্ষকদের জন্য রয়েছে সেই সম্মান। চীনে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পদ হলো শিক্ষকতা। ফ্রান্সের আদালতে কেবল শিক্ষকদেরকে চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়। আমেরিকার অনেক রাজ্যে শিক্ষকদের ভিআইপি মর্যাদা দেওয়া হয়। জাপানে সরকারের বিশেষ অনুমতি ছাড়া শিক্ষকদের গ্রফতার করা যায় না। কোরিয়ায় শিক্ষকরা মন্ত্রীদের সমান সুযোগ সুবিধা পান।
বাংলাদেশে শিক্ষকদের মর্যাদা কতটুকু তা আমরা সবাই জানি। সহকারী শিক্ষকদের বেতন সার্কভূক্ত সকল দেশের চেয়ে সর্বনিম্ন। যা দিয়ে একজন শিক্ষক তো দূরের কথা একজন সাধারণ মানুষেরও জীবন যাপন করা সম্ভব নয়।
তার মধ্যে শিক্ষক্রমের দ্রুত পরিবর্তন। ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমে সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়ন করেছিল। যা প্রায় ১২ বছর চলেছে। সে সময় অনেক আশার বাণী শোনানো হয়ছিল। কিন্তু তাও বেশিদিন টিকলো না। হঠাৎ করে চাপিয়ে দেওয়া কোন ব্যবস্থাই টিকতে পারে না। এবছরও নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হয়েছে তড়িঘড়ি করে। যার ফলে বছরের শুরুতেই হোঁচট খেতে হচ্ছে। জানুয়ারি মাস শেষের দিকে আসলেও এখনো সকল শ্রেণির সকল বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌছে দিতে পারে নি। তাছাড়া নতুন বইয়ে অনেক ভুল রয়েছে বলে অভিযোগ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। তা নিয়ে জনমনে নানান প্রশ্ন। অনেকেই বলছে এই শিক্ষাক্রম আদৌ বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এই বক্তব্যের সাথে তাঁরা যে সকল যুক্তি দেখিয়েছেন তা হলো : ১. এই শিক্ষাক্রমের শিক্ষাদান পদ্ধতি হবে আনন্দময়। ১২৫০০/= টাকা বেতন ও ১০০০/= টাকা বাড়ি ভাড়া এবং ৫০০/= টাকা চিকিৎসা খরচ দিয়ে একজন শিক্ষক তার পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকবেই বা কিভাবে? তাঁর মধ্যে আনন্দ কিভাবে আসবে?
২. এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়তে হবে না। প্রাইভেট না পড়াতে পারলে এই সামান্য টাকা বেতন দিয়ে শিক্ষকের সংসার কিভাবে চলবে?
৩. মরার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে আছে অবসর ভাতা ৬ শতাংশ এবং কল্যান ট্রাস্টে ৪ শতাংশ কেটে রাখা। যা অবসরে যাওয়ার পর বৃদ্ধ বয়সে ৪/,৫বছর ঐসব অফিসে দৌড়াতে দৌড়াতে অনেকে না পেয়েই মৃত্যবরণ করেন।
৪. দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া বৃদ্ধি শিক্ষকের ঐ সামান্য মাইনেতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। এই অবস্থায় একজন মানুষ কিভাবে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারে? মানবেতর জীবনযাপন করেও শ্রেণিকক্ষকে আনন্দময় করা কি আদৌ সম্ভব?
৪. বদলী ব্যবস্থা না থাকায় দূরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষকদের থাকার জন্য আবাসন নেই। যার ফলে অনুপযুক্ত পরিবেশের কারণে বিপাকে শিক্ষক ও তার পরিবার।
এতো সংকটে শ্রেণিকক্ষে আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করা কতটুকু কঠিন তা কারও অজানা নয়। নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে হলে শিক্ষকতা পেশাকে সর্বোচ্চ পদ মর্যাদা দিতে হবে। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করতে হবে। শিক্ষকদের সরকার শতভাগ বেতন দিচ্ছে, বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে দিচ্ছে। তাহলে কেন বেসরকারি থাকবে। শুধুমাত্র বাড়িভাড়া দিলেই জাতীয়করন সম্ভব। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর তহবিল সম্পর্কে আর কি বা বলবো। সরকারিকরণ হলে এই তহবিল সরকারি কোষাগারে জমা হবে। তাছাড়া শিক্ষকতায় মেধাবীদের নিয়ে আসতে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা অবশ্যই দিতে হবে। শিক্ষকদের সুযোগ সুবিধা ও যথোপযুক্ত সম্মান না দিয়ে কোন জাতি উন্নয়ন করতে পারে না।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, লবজান চৌধুরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সুনামগঞ্জ সদর, সুনামগঞ্জ।