বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার শেষ গ্রাম রাহুতলা। ‘বর্ষায় নায়, আর হেমন্তে পায়’ ছাড়া এই ইউনিয়নের কোনও গ্রামে উপায় নেই যাতায়াতের। রাহুতলা গ্রামের উত্তর পশ্চিমে নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলা। গ্রামের গ্রামীণ বাজারেই প্রায় তিন দশক আগে আটগাঁও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ হয়েছিল। দুর্গম ইউনিয়নবাসীকে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা দানের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হলেও জনগণের কোন উপকারেই আসেনি। দুটি ভবনসহ চিকিৎসক ও অন্যান্যদের জন্য নির্মাণ করা ভবন ব্যবহারের অভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। দুর্গম এলাকার জনগণের কাঙ্খিত সেবায় আসতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। এখন সংষ্কার ও লোকবলের অভাবে ভবনটি জীর্ণশীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। তাই ইউনিয়নবাসী কোনও সেবা পাচ্ছেনা। দুর্গম এলাকা থেকে জেলা, উপজেলা বা বিভাগীয় শহরে চিকিৎসার জন্য রোগি নিয়ে আসতে আসতেই অনেকে পথে মারা যাচ্ছে বলে জানান এলাকাবাসী। তারা দুর্গম এলাকায় প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি সংস্কার ও লোকবল দিয়ে সেবা কার্যক্রম শুরুর দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিন গত ৩ মে এই ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ভবনের মূল দরোজা ভাঙ্গা। জানালা গুলো চটবাঁশে বেঁধে রাখা হয়েছে। পিছনে চিকিৎসকের আবাসিক কক্ষের দরোজা জানালা ভাঙ্গা এবং উপরের টিন নেই। ভেতরের সেবা ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম রাখা কক্ষে তালা ঝুলছে। মেঝেতে গোপশুর মলমূল ও ময়লার স্তুপ। বাথরুমের দরোজা নেই। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ১৯৮২ সনে আটগাঁও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। এই কেন্দ্রে একজন উপসহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, ফার্মাসিস্ট, পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক, অফিস সহায়ক, নিরাপত্তাপ্রহরীসহ ৫ জনের পদ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু এই কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হলেও কমিউনিটি মেডিকেল অফিসারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদের সবগুলো পদই শুন্য রয়ে যায়। কেবল মাত্র পরিবার কল্যাণ পরিদর্শক মাঝে-মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হতো। বর্তমানে একমাত্র অফিস অফিস সহায়ক এনামুল হক নামকাওয়াস্তে কেন্দ্রটির দায়িত্ব পালন করছেন। জ্যোতিকা রায় নামে একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি শাল্লা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করেন। যার ফলে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। অফিস সহায়ক মাসে ২-৩ বার কেন্দ্র থেকে সরকারি ওষুধ বিতরণ করেন। তাই পুরো মাসই বন্ধ থাকে প্রতিষ্ঠানটি। দরোজানা জানালা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অরক্ষিত আছে প্রতিষ্ঠানটি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবনটির বেহাল দশা ও লোকবলের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে সংষ্কারের অনুরোধ জানিয়ে লিখিত আবেদন করেন উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলায় ৪৬টি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র আছে যেগুলোর দুই তৃতিয়াংশ লোকবল সংকটের কারণে সেবা দিতে পারছেনা। তাছাড়া দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এতে গ্রাম এলাকার মানুষের উন্নত স্বাস্থ্যসেবার জন্য গড়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কাঙ্খিত সেবাও পাচ্ছেনা।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পার্শবর্তী মীর্জাপুর গ্রামের কৃষক মোছানুর মিয়া বলেন, আমরা খুব অসহায়। সামান্য রোগ হইলেও চিকিৎসা নেওয়ার ব্যবস্থা নাই। নেত্রকোণার খালিয়াজুড়ি বা দিরাই উপজেলায় যাইতে হয়। আমাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রটিও ভাইঙ্গা পড়ছে। মাঝে-মধ্যে একজন পিয়ন আইসা খুলে। কিছু অষুধপত্র দেয়।
রাহুতলা গ্রামের যুবক সোহেল রানা বলেন, প্রতি সপ্তাহে পিয়ন এসে একদিন খুলে। নাপা, কিছু সিরাপ পাওয়া যায়। প্রতিদিন খুললে এবং চিকিৎসক থাকলে আমাদের দুর্গম এলাকার গরিব রোগিরা সেবা পেতো। তিনি স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি সংস্কার করে নিয়মিত খোলার রাখার দাবি জানান।
আটগাঁও ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড সদস্য শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, আমাদের যোগাযোগ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা নাজুক। প্রায় ২২ হাজার লোকের বসবাস আমাদের ইউনিয়নে। ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকলেও কখনো পুরোপুরি সেবার জন্য দ্বার উন্মোচন হয়নি। এভাবে থাকতে থাকতেই নষ্ট হয়ে গেছে। জঠিল রোগীদের নিয়ে যেতে হলে হেমন্তে পায়ে হেটে আর বর্ষায় নৌকায় নিতে হয়। এর আগেই অনেকে মারা যায়।
শাল্লা উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) বিশ্বজিৎ কৃষ্ণ চক্রবর্তী বলেন, আটগাঁও ইউনিয়নের রাহুতলা অত্যন্ত দুর্গম এলাকা। এ কারণেই এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বর্তমানে বেহাল স্বাস্থ্য কেন্দ্র সংষ্কারের জন্য আমরা উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে লিখেছি। এখানে বর্তমানে একজন অফিস সহায়ক কোনমতে কেন্দ্রটি চালু রেখেছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিকাশ কুমার দাস বলেন, জেলায় এরকম ৪৬টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে। লোকবল ও সংষ্কারের অভাবে কাঙ্খিত সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তবে সরকার সম্প্রতি লোকবল দিয়ে দুর্গম এলাকার মানুষের চিকিৎসার জন্য গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলো সচল করার উদ্যোগে কাজ শুরু করেছে বলে জানান তিনি।