বিশেষ প্রতিনিধি::
সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার নাজিরবাজারে কাকডাকা ভোরে বালুবাহী ট্রাক ও পিকআপের সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন সুনামগঞ্জের হতদরিদ্র পরিবারের ১২ জন শ্রমিক। মর্মান্তিক দুর্ঘটনার সংবাদ তাদের পরিবার ও এলাকায় এসে পৌঁছলে কান্নার রোল ওঠে। বুধবার সন্ধ্যায় লাশ গ্রামে আসার পর কান্নায় ভেঙ্গে পরেন স্বজনরা। স্বজনদের শান্তনা দিতে এসে প্রতিবেশিরাও কাঁদছেন। শোকের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠছে নিহতদের এলাকা। অনেক পরিবারের কর্মক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে অসহায় হয়ে পড়ছে পরিবারটি।
সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিরা জানান, দিরাই উপজেলার ভাটিপাড়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামের নিহতরা হলেন ভাটিপাড়া গ্রামের মৃত সজিব আলীর ছেলে রশিদ আলী (২৫), সিরাজ মিয়ার ছেলে সৌরভ মিয়া (২৭), শমসের নুরের ছেলে মেহের (২৪), মৃত মফিজ মিয়ার ছেলে সায়েদ নূর (৫০), একই গ্রামের শাহজাহানের ছেলে বাদশা (২২) ও ওই ইউনিয়নের আলীনগর গ্রামের শিশু মিয়ার ছেলে হারিস মিয়া (৬৫)। তারা সবাই শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে পিকআপে সিলেট থেকে ওসমানীনগরের দিকে যাচ্ছিলেন। এসময় দুর্ঘটনায় মারা যান। দুর্ঘটনায় একই উপজেলার গচিয়া গ্রামের বারিক উল্লার ছেলে সিজিল মিয়া (৫৫), কাইমা মধুপুর গ্রামের সোনা মিয়ার ছেলে সাধু মিয়া (৪০) ও মৃত ছলিম উদ্দিনের ছেলে একলিম মিয়া (৫৫) মারা যান।
এছাড়াও সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুর গ্রামের মৃত হারুন মিয়ার ছেলে দুলাল মিয়া (২৬), একই উপজেলার পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের বাবনগাঁ গ্রামের মৃত ওয়াহাব আলীর ছেলে শাহিন মিয়া (৪০), শান্তিগঞ্জ উপজেলার তলেরবন গ্রামের মৃত আওলাদ উল্লার ছেলে আওলাদ হোসেন (৬০) দুর্ঘটনায় মারা যান।
এদিকে সন্ধ্যায় নিহতদের লাশ গ্রামে এসে পৌঁছলে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভাটিপাড়া ইউনিয়নের আলীনগর গ্রামের দিনমজুর হারিস মিয়া দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার কিশোর ছেলে সেপুল মিয়া গুরুতর আহত হয়েছে। দিনমজুর পিতা ও পুত্র মিলে ৭ জনের সংসার পরিচালনা করতেন। পিতার মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় মুষড়ে পড়েছে পরিবারটি।
সন্ধ্যায় লাশ যখন বাড়িতে পৌঁছে তখন হারিস মিয়ার কলেজ পড়–য়া মেয়ে তাসলিমা আক্তার ও তার স্ত্রী শিরোপা বেগম লাশের উপর এসে আছড়ে পড়েন। তাদেরকে ধরে রাখতে পারছিলেননা স্বজনরা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শিরোপা বেগম বলছিলেন, ‘ওগো তুমি গেলায়গি, এখন চলতাম কিলা। মেয়েরে বিয়া দিতাম কিলা। আল্লা তুমি আমরার উফর অত বিপদ দেও কেনে। আর কত সহ্য করতাম আল্লা’।
হারিস মিয়ার মেয়ে তাসলিমা আক্তার বাবার মৃত্যুতে নির্বাক হয়ে গেছেন। এখন পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তি তার কিশোর ভাই সেপুল মিয়া। সেও গুরুতর আহত হয়েছে। তাসলিমা বলেন, ‘বাবা কষ্ট করে সংসার চালাতেন। তারপরও আমার লেখাপড়া করার কথা বলতেন। তিনি আমাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে বলেছিলেন তোমাকে অনেক দূর যেতে হবে। আমি রক্ত বিক্রি করে হলেও তোমাকে পড়াব। কিন্তু এখন বাবার মৃত্যুতে আমার পড়ালেখাতো দূরের কথা আমার পরিবার চলবে কিভাবে এটা নিয়েই আমরা উদ্বিগ্ন।’
ভাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত ওয়ার্ডের সদস্য মোছা. পিয়ারা বেগম বলেন, আমাদের ইউনিয়নের ৬জন শ্রমিক মারা গেছে। তারা সবাই দিন আনে দিন খায়। খুবই অসহায়। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে পরিবারও বিপদে পরেছে। তাদেরকে মানবিক সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, এই দুর্ঘটনায় পুরো গ্রামের মানুষ নির্বাক হয়ে গেছেন। নিহতদের পরিবারকে শান্তনা দিতে এসে সবাই কাদছেন।
ভাটিপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বদরুল ইসলাম চৌধুরী মিফতাহ বলেন, আমার ইউনিয়নের ৬জন সহ আমার উপজেলার ৯জন শ্রমিক মারা গেছেন। তারা খুবই অসহায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়রপ্রার্থীর পক্ষ থেকে তাদেরকে কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আমরাও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের প্রতি খোজ রাখব।