বিশেষ প্রতিনিধি::
বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের গোড়া পত্তনের সময় সামাজিক, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বৃটিশ সরকার বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ‘টাওন হল’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সুনামগঞ্জ শহরেও এই নামে এরকম একটি স্থাপনা করেছিল। শহরের মূল এলাকা ট্রাফিক পয়েন্টেই আজকের টাওন হল। ঠিক কবে টাওন হল প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইতিহাসের সেই লিখিত কোন ডকুমেন্ট পাওয়া যায়নি। বৃটিশ আমলের একেবারে শেষে এখানে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে সুনামগঞ্জ কলেজ হাছননগরে নতুন ক্যাম্পাসে চলে যাওয়ায় পুরোপুরি পরিত্যাক্ত ছিল এলাকাটি। স্বাধীনতার পর স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ীর দৃষ্টি এদিকে পড়ার পর পৌরসভা ও প্রশাসনের মৌন সমর্থনে শুরু হয় মার্কেট নির্মাণের তৎপরতা। স্বাধীনতার পর মার্কেট নির্মাণ করে বাণিজ্যিকভাবে এলাকাটি ব্যবহৃত হলেও সরকার এক টাকাও রাজস্ব পাচ্ছেনা। পৌরসভাও বঞ্চিত পৌর কর থেকে। ২০১২ সনে প্রশাসন এই ভবনকে ঝূকিপূর্ণ ভবন হিসেবে ঘোষণা করেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে ‘টাওন হল’র নামে ১৫ শতক মূল্যবান ভূমি জেলা প্রশাসনের ১নং খতিয়ানে রেকর্ডভূক্ত। এলাকাটিতে ব্যবসায়ীক স্থাপনা করে ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৭৫-১৯৭৬ সনে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় পৌরসভা ‘টাওন হল কমিটি’ নামে একটি কমিটি করে। ওই কমিটি বসে একটি মার্কেট নির্মাণ কার্যক্রমের পরিকল্পনা নেয়। ১৯৮৮-১৯৮৯ সনে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মার্কেট নির্মাণে হাত দেন তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী। জেলা প্রশাসনের মৌন অনুমতিও আদায় করে নেন তিনি। শহরের প্রাণকেন্দ্রের এই মূল্যবান ভূমিতে তাড়াহুড়ো করে অপরিকল্পিত একটি মার্কেট নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে অন্তত ২৫ জন ব্যবসায়ীকে মৌখিক দোকান কোটা বরাদ্দ দেওয়া হয়। যাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল তারাই পান দোকান কোটা বরাদ্দ। আইনগত জঠিলতার কারণে কাউকেই বৈধ কোনও কাগজপত্র দেওয়া হয়নি। এরপর থেকেই ব্যবসায়ীরা এই মার্কেটে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সরকারের মালিকানাধীন এই ভূমি থেকে সরকার কোনও রাজস্ব পায়না। পৌরসভাও এখান থেকে কোন পৌরকর পায়না। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত ও জড়াজীর্ণ মার্কেটটি ঝূঁকির পাশাপাশি শহরের প্রধান কেন্দ্রের সৌন্দর্য্যহানীরও অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তাছাড়া ২০১২ সনে ফায়ার সার্ভিস এই ভবনটিকে মেয়াদোত্তীর্ণ ও ঝূকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ী ও সুধীজন জানান, বর্তমানে শহরের প্রাণ কেন্দ্রের এই ভবনটি কেবল শহরের সৌন্দর্য্যহানীই করছেনা। এখন জড়াজীর্ণ অবস্থায় বিরাট ঝূঁকির কারণ হয়ে দাড়িয়ে আছে। যে কোন সময় সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই শহরের মূল কেন্দ্রে এরকম জীর্ণশীর্ণ ভবন অবিলম্বে ভেঙ্গে দৃষ্টিনন্দন বাণিজ্যিক ভবন করা যেতে পারে। এতে ব্যবসার বিকাশ ঘটবে। সরকারও মোটা অংকের রাজস্ব পাবে।
জানা গেছে জনদাবির প্রেক্ষিতে সম্প্রতি সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন কাজ শুরু করেছে। তারা মৌখিক দোকান কোঠা বরাদ্দ পাওয়া ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছে। তাদেরকে ব্যবসায়িক পজিশন বরাদ্দের সুযোগ রেখে এখানে বহুতল আধুনিক বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে।
টাওন হল মার্কেটের একটি কক্ষের মালিক আনিসুজ্জামান ইমন বলেন, আমরা ৩০ বছরের অধিক একটি কক্ষে ব্যবসা করে আসছি। মার্কেট প্রতিষ্ঠার সময় আমাদের পরিবার অর্থ দিয়েছিলেন। তাই আমাদেরকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রশাসন কিছু করলে আমাদের কথাও মাথায় রাখতে হবে।
সুনামগঞ্জ পৌর মেয়র নাদের বখত বলেন, বৃটিশ আমলে এটি টাওন হল নামে পরিচিত। নাগরিকদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং সমাজ বিকাশের স্বার্থে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা টাওন হল কমিটি করে এটির ব্যবস্থাপনায় হাত দেন। এরপর থেকেই ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভবন করে বিভিন্নজনকে মৌখিক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এখান থেকে পৌরসভা কোন পৌরকর পায়না। তবে এখন প্রশাসন নিজেদের মূল্যবান জায়গায় বহুতল বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স করার চিন্তা ভাবনা শুরু করেছে। আমাদেরও তাতে সমর্থন রয়েছে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট খায়রুল হুদা চপল বলেন, শহরের প্রাণ কেন্দ্র টাওন হল। সরকারের মূল্যবান সম্পত্তি। কিছু মানুষ অবৈধভাবে এটি দখল করে আছে। এখন পরিবেশটাও গিঞ্জি। অপরিকল্পিতভাবে করা মার্কেটটিও খুবই জড়াজীর্ণ। যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই প্রশাসনের তত্বাবধানে এখানে দৃষ্টিনন্দন বহুতল বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স করে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ব্যবসার সুযোগ করে দিলে শহরের পরিবেশও সুন্দর হবে, সরকারও রাজস্ব পাবে।
অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক বিজন সিংহ বলেন, ১নং খাশ খতিয়ানের টাওন হলের নামে ১৫ শতক মূল্যবান ভূমি রয়েছে। এর মালিক জেলা প্রশাসন। এখন যারা এখানে আছেন তারা ১৯৭৫-১৯৭৬, ১৯৮৮-১৯৮৯ সন থেকে বিভিন্ন সময়ে নিজেরা ভবন নির্মাণে অর্থ ব্যয় করে দোকান কোটার পজিশন নিয়ে আছেন। তারা কেউ এই জায়গার মালিক নন। তবে তাদেরকে পুনর্বাসনের আওতায় রেখে আমরা এখানে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স করার চিন্তা ভাবনা শুরু করেছি। ইতোমধ্যে কাজও শুরু হয়েছে। এটি হলে শহরের সৌন্দর্য্য বাড়বে। যেহেতু এটি বাণিজ্যিক স্পেস সে হিসাবে সরকারের রাজস্বও আসবে।