1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৫৩ পূর্বাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::
জামালগঞ্জে নবাগত জেলা প্রশাসকের মতবিনিময় সভা সিলেটে শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসারকে অপসারণের দাবিতে গণস্বাক্ষর কার্যক্রম ২৫০ শয্যা হাসপাতালে সেবার মান বাড়ানোর দাবিতে মতবিনিময় সুনামগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দোয়া ও মিলাদ বন্যার্তদের সহায়তায় সুনামগঞ্জে শিল্পকলা একাডেমির ব্যতিক্রমী ছবি আঁকার কর্মসূচি জগন্নাথপুরে শিক্ষিকা লাঞ্চিত: দোষীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী সকল কালাকানুন বাতিলের দাবি সাবেক ছাত্রলীগ নেতা পান্নার মরদেহ হস্থান্তর করলো মেঘালয় পুলিশ কাদের সিদ্দিকী বললেন: বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এক নয় বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বন্যায় ২০ লাখ শিশু ঝুঁকিতে : ইউনিসেফ

স্মরণ : আমৃত্যু আওয়ামী লীগের প্রদীপ ধরে রেখেছিলেন অলিউল হক।। সুশান্ত দাস

  • আপডেট টাইম :: বুধবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২৪, ৬.৩২ পিএম
  • ৫৭ বার পড়া হয়েছে

ষড় ঋতুভেদে হাওরের জলজ,স্থলজ পরিবেশ স্পষ্টত। জলজ পরিবেশে জলের ঢেউ এর ন্যায় সদ্য সমাপ্ত হলো নির্বাচনী ঢেউ। কেউ হেরেছেন কেউ জিতেছেন। আবার কেউ রুটি-হালুয়া ভাগবাটুয়ারার জন্য অপেক্ষা করছেন। এখানকার ভৌগলিক পরিবেশে বেড়েওঠা মানবকূলের জীবন আবাসন ও রাজনৈতিক পরিবেশটা পরিলক্ষিত করার মতো। আর এই রাজনীতিক পরিবেশে যে-সমস্ত হাওর সন্তানদের নিরলস পরিশ্রম, প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে, আত্মত্যাগ নিবেদন করেছেন তা সত্যিই ইতিহাসের মাপকাঠিতে প্রণিধান যোগ্য। ভাটির হাওরের রাজনীতিতে এমননি এক রাজনীতিক ব্যক্তি শেখ অলিউল হক। গত ২৮(২০২৩) ডিসেম্বর দিবাগত মধ্যরাতে উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের কাশীপুর গ্রামের নিজ বাড়িতে প্রয়াত হয়েছেন। ছিলেন শাল্লা উপজেলা আওয়ামীলীগের চলমান সভাপতি। ছাত্র আন্দোলনের সময়কাল হতে তাঁর ছাত্র রাজনীতিতে প্রবেশ। সেই আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ যখন দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন তখন থেকে তিনি আওয়ামীলীগ। কাজেই একজন উলিউল হককে জানতে গেলে ইতিহাসের পেছনের দিকগুলো আমাদের দেখতে হবে।
যদিও নওয়াগাওঁ সাম্প্রদায়িক হামলার(২০১৭) সময় তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার জীবনে পরিবারের জন্য প্রশ্নবিদ্ধ; ফেলতে হয়েছে চোখের জল। সেদিনের সংবাদপত্রগুলো তাই বলে।

ভাটির রাজনীতি খোঁজতেগিয়ে কমরেড শ্রীকান্ত দাশের লেখা হতে জানাযায়- “ ১৯৪৬ ইংরেজীতে কমিউনিস্ট পার্টি মনোনীত প্রার্থী শ্রদ্ধেয় কৃষকনেতা স্বর্গীয় কমরেড করুণাসিন্ধু রায়ের নির্বাচন চলাকালীন আঙ্গারুয়া গ্রামে সর্বপ্রথম লাল ঝান্ডা উত্তোলন করা হয়। এই সময় হতে কংগ্রেস, কমিউনিস্ট এই দুই রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে। ১৯৪৭-এ দেখা যায় কংগ্রেস,কমিউনিস্ট ও নতুন প্রজন্ম মুসলীমলীগ এই তিন দলের বাতাসে শাল্লা মুখরিত”। (মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে শাল্লা ‘রাজনীতি-৩)।

সিলেট জেলার প্রথম মহকুমা সুনামগঞ্জে,স্থাপিত হয় ১৮৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে। ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে সিলেটকে বৃহৎ-বঙ্গের ‘ঢাকা ডিভিশন’এর সংগে রাখা হয়। ১৮৬৭ সালে ঘোষ-বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সিলেট জেলাকে সুনামগঞ্জ,করিমগঞ্জ,হবিগঞ্জ ও সিলেট সদর এই ৪টি ক্ষুদ্র প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করা হয় (সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতি,প্রথম প্রকাশ,পৃ-২২/২৩)।
ইতিহাস ঘাটাতে চোখেপড়ে ১৯৫৬ সালের ২৬ নভেম্বর রোজ সোমবার বঙ্গবন্ধুর হাতে জন্মগ্রহণ করে সুনামগঞ্জ মহকুমা আওয়ামীলীগ। উক্ত কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদ দু’জনই ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন(সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুহাম্মদ আব্দুল হাইকে সাধারণ সম্পাদক ও প্রখ্যাত ছাত্র ইউনিয়ন নেতা গুলজার আহমদকে(দিরাই) সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়)।

আবার দেখা যায় সুনামগঞ্জে কমিউনিস্ট পার্টির ভাবাদর্শের উন্মেষ ঘটে ত্রিশের দশকে। স্বদেশি ও অসহযোগ আন্দোলনে তৎকালীন জেলখাটা তরুণরা কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শকে স্বযত্নে লালন করলেও কংগ্রেসের ছদ্মাবরণে কাজ করেছিলেন। ১৯৩৬ সালে ‘শ্রীহট্ট কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠনের পর ( কোন কোন বইয়ে ১৯৩৫) বহু নেতাকর্মী কংগ্রেস থেকে বেড়িয়ে আসে। সুনামগঞ্জের কমিউনিস্টরা গ্রামে পর্যন্ত তৎপরতা বাড়িয়ে কৃষকদের সংগঠিত করেছিলেন। তাই ইতিহাস সমৃদ্ধ ও নতুন প্রজন্ম জানার জন্য পূর্বসূরীদের চেনা অতীবগুরুত্ব।
প্রথমদিকে দীনেশ চৌধুরী, করুণাসিন্ধু রায়,দিগেন্দ্র দাসগুপ্ত,লালা শরদিন্দু দে(সুনামগঞ্জ জুবিলী হাইস্কুলের প্রবাদপ্রতীম তৃতীয় প্রধান শিক্ষক লালা প্রসন্নকুমারের ৭ম পুত্র , অনেকের কাছে বুলি লালা হিসেবে পরিচিত), চিত্তরঞ্জন দাস,চঞ্চল শর্মা,রবি দাম, রোহিনী দাস,বিনয় চৌধুরী, লালমোহন রায় প্রমুখ কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে কাজ করেছিলেন। পরে বরুণ রায়,হেনা দাস,হাজেরা মাহমুদ প্রমুখ কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বেগবান করতে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে ছিলেন। তবে সুনামগঞ্জে বসবাসরত শ্রীমঙ্গলের পানিনি দত্তের (ফনীন্দ্রনাথ) প্রভাবও যথেষ্ট ছিল(প্রখর মেধার অধিকারী ফণীন্দ্রনাথ ছিলেন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। ইন্ডিয়া মার্চেজ অন,ইন্ডিয়া ওয়ার্কিং ক্লাস এবং জাতীয় মুক্তি ও গণসংগ্রাম-এই তিনটি বই লেখার কারণে ১৯৪১ সালে ভারত-রক্ষা আইনে তাঁকে ছয় মাসের কারাদন্ড দন্ডিত করা হয়েছিল। ঐ বই ৩টি তিনি পানিনি ছদ্মনামে লিখেছিলেন এবং তখন থেকেই তিনি ‘পানিনি’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের তাত্ত্বিক বিষয়গুলো ফণীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সহজ ভাষায় সুনামগঞ্জের বিপ্লবী দলের সদস্যদের কাছে তুলে ধরতেন)।
ব্রিটিশ হটানোর জন্য ত্রিশের দশকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে সুনামগঞ্জে তরুণরা জড়িত ছিলেন। বিপ্লবী তরুণ সংঘের মূল লোক ছিলেন ছাতকের চঞ্চল শর্মা ও সুধাংশু শর্মা(শহীদ)। সুনামগঞ্জে কয়েকটি পাঠাগার ও ব্যায়াম কেন্দ্রকে ঘিরে বিপ্লবী কর্মকান্ডের প্রস্তুতি চললেও পরে বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টির দিকে ঝোঁকেছিলেন। স্থানীয় ভাবে কাজ করেছিলেন লালা শরদিন্দুদে,দেবেন্দ্র দত্ত,চিত্তরঞ্জন দাস,প্রশান্ত কুমার দে,দীনেশ চৌধুরী, প্রচোতকুমার শর্মা,উমেশ শ্যাম,বিনয় চৌধুরী,গিরিজাকুমার ভদ্র,রোহিণীকুমার দাস,রবীন্দ্রনাথ দাস,প্রমোদচন্দ্র এষ,অঙ্গিকাকুমার শর্মা,বেনু বিনোদ চৌধুরী প্রমুখ। বিশ ও ত্রিশের দশকে সুনামগঞ্জে কয়েকটি কৃষক আন্দোলনে কমিউনিস্টরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা রবি দামকে পাকিস্তান-পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল। সুনামগঞ্জের আরেক নেতা করুণাসিন্ধু রায়কে ‘কৃষকবন্ধু’ নামে অভিহিত করা হতো। তিনি বিখ্যাত শ্রীহট্ট(সিলেট)প্রজাস্বত্ব আইন শিলং ব্যবস্থাপনা সভায় উপস্থাপন করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে বর্তমানে ভাটিবাংলার সাধারণ কৃষকপরিবার জমির মালিকানা পেয়েছে।

সুনামগঞ্জ মহকুমার ইতিহাস পর্যবেক্ষন করলে আরো দেখাযায়, সেই ব্রিটিশ আমল তথা ত্রিশের দশক হতে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম হলেও ৪২সালের ভারত ছাড় আন্দোলন,কৃষক আন্দোলন,শ্রমিক আন্দোলন,আসাম প্রাদেশিক পরিষদের প্রতিনিধিত্ব,গণভোট,পাকিস্তান সূচনালগ্নে বিদ্রোহের সূচনা,ভাষা আন্দোলন,৫৪’র নির্বাচন,৬২’র ছাত্র আন্দোলন,৬৬’র ছয় দফা,৬৯’র গণঅভুত্থ্যান,৭০’র নির্বাচন,স্বাধীনতা অতঃপর নব্বই সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত কমিউনিস্ট রাজনীতি, বাম ও প্রগতিশীল রাজনীতির(একতা,ন্যাপ,গণতন্ত্রী পার্টি) ভাবধারায় সমোদয় অঞ্চলে বেশ প্রবলতা ছিল বিশেষ করে দিরাই-শাল্লা। এই কমিউনিস্ট রাজনীতি, বাম ও প্রগতিশীল রাজনীতির প্রকটতা ও বাম বলয়ের রেশের মাঝে হাতেগুনা যে-ক’জন আওয়ামী আদর্শের প্রদীপ জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁদের অন্যতম শেখ অলিউল হক।

১৯৫২ সালের ১৮ জানুয়ারি সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্র ইউনিয়ের জন্ম। অতঃপর নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসনের পূর্ব পর্যন্ত সংগঠনটি কর্মকান্ড অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। ১৯৫৫ থেকে প্রায় ৬/৭ বছর ছাত্রনেতা গুলজার আহমদ সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করেন।এই সময়ে আরো যেকজন ছাত্র ইউনিয়ন নেতার নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন- গিরীন্দ্র কুমার দাস,শওকতুল ইসলাম,হিরণ্ময় ভট্টাচার্য,শামসুজ্জামান চৌধুরী সুফি,বিমান বিহারী নাগ,জ্ঞানব্রত দাস,ফজলুল বারী,সরোজ চৌধুরী প্রমুখ। ৬২’র ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে ছাত্রনেতা গুলজার আহমদ সুনামগঞ্জ কলেজ হতে ইন্টারমেডিয়েট পাস করে সিলেটে চলে যান। সেখানে প্রথমে তিনি সিলেট জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। গুলজার আহমদ সিলেট চলেগেলে সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে ওঠেন চৌধুরী মনসুর আহমদ। বামরাজনীতির ওপর তাঁর ছিল প্রখর তাত্ত্বিক জ্ঞান। ১৯৬২ সালের ১৪জুলাই চট্টগ্রামের রেলওয়ে স্টেশন ও লালদিঘি ময়দানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাটিচার্জ করে এবং সেই সংগে সরকারের ভাড়াটিয়া গুন্ডাবাহিনীও হামলা করে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ২০জুলাই সুনামগঞ্জের কলেজ ও স্কুল সমুহে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। ২৪ জুলাই (১৯৬২) শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা স্বতঃস্ফুর্তভাবে একযোগে রাজপথে নেমে আসে। সেদিনের দুঃসাহসিক কাজটি হলো- সুনামগঞ্জ বাজারের দোকান ও ব্যবসায়ী-প্রতিষ্ঠানগুলোতে লটকিয়ে-রাখা আইয়ুব খানের সব ছবি টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে আনা এবং প্রকাশ্যে রাজপথে ছবিগুলো ভেঙ্গে-গুড়িয়ে স্তূপীকৃত করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া। ঠিক তখনই পুলিশ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রেফতার করে মনসুর আহমদ,মানসকমল রায়,গোলাম রব্বানী,মাহবুব আলী,বসন্ত কুমার সাহা,সীতাংশুকুমার চৌধুরী মিনু,রণবীর চৌধুরী তপন প্রমুখ।

সুনামগঞ্জ মহকুমায় ছাত্র ইউনিয় জন্মের প্রায় ১১বছর পর ১৯৬৩ সালের ৩০মে ছাত্রলীগ গঠন হয়। এখানেও ছাত্র ইউনিয়নের ছাত্র নেতাদের নাম দেখা যায়। উল্লেখ্য
মহকুমা ছাত্রলীগ শাখা গঠনের উদ্দেশ্যে ছাত্রলীগ নেতা এনাম আহমদ যখন সুনামগঞ্জে এলেন,” তখন এখানে ছাত্র সংগঠন বলতে কেবল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকেই বোঝাত। মহকুমা শহরে এরকম রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগের শাখা গঠন করা ছিল সত্যিই দুষ্কর”। (সুনামগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ও তৎকালীন রাজনীতি,প্রথম প্রকাশ,পৃ-১৮০)।

হাওর-ভাটির রাজনীতিক শেখ অলিউল হকের জন্ম ১৯৪১ সালে। কমরেড পুত্র সুকান্ত দাশ’র বদান্যতায় গত ৩ অক্টোবর ২০২৩ দীর্ঘ ভিডিও আলাপচারিতায় জানা যায় তিনি রাজানগর হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন। ১৯৬২ সালে মেট্রিক পরীক্ষার্থী ছিলেন। ঠিক ঐ সময় হতে আওয়ামীলীগ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। তখন আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ দলের সভাপতির(১৯৫৬-১৯৬৭) দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
অলিউল হকের পারিবারিক পরিচয় পিতা শেখ রাশেদ
উল্লা ও মাতা গোলাপ জান বিবি। তাঁদের চার ছেলে ও দুই কন্যা সন্তান ছিল। তাঁদের ছয় সন্তানদের মাঝে অলিউল হক তিন নম্বর সন্তান ছিলেন। তিনি জানান পারিবারিক ভাবেই তিনি শেখ টাইটেল ব্যবহার করে আসছেন। অলিউল হক আরো বলেন এক ঘর করে মুসলমান,ঠাকুর, দাস, নাপিত, সূত্রধর, ধূপা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মিলিত ভাবে কাশিপুর গ্রামের নাম শুরু করেন।
অলিউল হকের সাথে প্রথম কবে কখন দেখা হয়েছিল তা মনেনেই। তখন ধর্মীয় ভাবাবেশ ছিলো না। ক্লিনশেভ, উজ্জ্বলবর্ণ, পান-চিবানো মিষ্টিমুখখানির মৃদু কন্ঠ বুঝি এখনো কানে লাগছে! তবে ভাটির আলোকবর্তীকা ‘গিরিধর উচ্চ বিদ্যালয়’এ ভর্তির সুবাধে প্রায় সময় স্কুলে হাঁটতে দেখা যেতো। দেখা যেতো প্রয়াত শিক্ষক প্রহ্বলাদ বাবু(হবিবপুর,নওয়াগাঁও),প্রধান শিক্ষক উপেন্দ্র বাবু(কাশিপুর),প্রয়াত শিক্ষক বিনোদ বিহারী বাবু(শাশখাই),শিক্ষক সচীন্দ্র বাবু(হবিবপুর),প্রভাকর চৌধুরী(জয়পুর),মৌলভী শিক্ষক জনাব কুদ্দুস সাহেব(কাশিপুর),বিশ্বেম্বর মেম্বার(আনন্দপুর), প্রায় সময় গ্রুপ বেঁধে হাঁটছেন। তবে দিরাই/ঘুঙ্গিয়ারগাওঁ আসা-যাওয়া পথে কিংবা ঘুঙ্গিয়ারগাওঁ বাজারে বিভিন্ন প্রোগ্রামে গেলে দেখা হয়ে যেতো।

আজ সুস্পষ্ট ভাবে মনেহচ্ছে ‘গিরিধর উচ্চ বিদ্যালয়’-এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রদ্ধাষ্পদ বাবু মহেন্দ্র মাস্টারের কনিষ্ঠ পুত্র মহিতোষ বাবু অকালে প্রয়ানের ফলে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি সহ তাঁর বাড়ির ভূমিসীমা নিয়ে ধেঁয়ে আসে কালো হাতের ছোঁবল। সেই সময়ে একটার পর একটা মিটিং, গ্রাম্য শালিসি এক পর্যায়ে একদিন ওলিউল হক,প্রভাকর চৌধুরী,উপেন্দ্র বাবু(বাহারা),অধীর বাবু(ডুমরা) তাঁরা সবাই আমাদের বাড়িতে গেলে,বাবা বলেন তোমরা জানো গ্রাম্য শালিসি-বিচারাদিতে আমি নাই, কাজেই তোমরা থাকতে আমার শিশু মৃদুলের(বর্তমান গিরিধর হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি) উপর যেন এমন আচর আর না পড়ে, তোমরা এই সমস্যা সমাধান করে যাও। উনারা বাবার বয়সে সবাই ছোট, সবাই প্রয়াত।

১৯৯৬ সালের বর্ষা মৌসুম। তুখোড় রাজনীতিকদ্বয়
সামাদ আজাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। সামাদ আজাদের আগমন উপলক্ষে শাল্লা সদর মানে ঘুঙ্গিয়ারগাওঁ বাজারে বাহারা ইউনিয়ন অফিসের সামনে মিটিং। সেদিন ছিলাম বাজারে, ভাবলাম বাজারে যেহেতু আসছি তাহলে মিটিং দেখে যাই। দেখি মিটিং প্রায় শেষ। সেই মুহুর্তে অলিউল চাচা পান-ভর্তি মুখে হেসে ডাকছেন ভাতিজা সামনে আসো। পরে পরাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদের সাথে কদমবুচির সহিত হেন্ডশেক ও গলাগলি করি। স্বৈর শাসক এরশাদ হটিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার ১৯৯১ সালের নির্বাচন। তখন প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে যাব বা গিয়েছি। এই নির্বাচনকে ঘিরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তর জন্য ১৪দলীয় জোট সহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের শাল্লায় আগমন। চলছে নির্বাচনী জনসভা। একেতে বয়সে শিশু, অন্যতায় জনসমাবেশের ভীড়, জনসভার ভীড়ে কে; কাকে পাত্তা দেয়। অবশেষে জনসমাবেশের পরে শাল্লা কৃষি ব্যাংক ও থানার মধ্যখানে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর সাথে হেন্ডশেক ও গলাগলি করতে পাশে দেখি অলিউল হক সুপারি চিবিয়ে মুশকি হাসছেন(বর্তমান কাদের সিদ্দিকীর প্রতি এমন আগ্রহ নেই, এক মুক্তিযোদ্ধার জানাযা-ই সব মিশিয়ে দিয়েছেন)।
শুধু তাই নয় ৯৬ সালের সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা যখন শাল্লা যান তখন এলাকার অনেক গন্যমান্যদের ন্যায় বাবাকে একটি নিমন্ত্রন পত্রের সংগে ভিআইপি কার্ড দেওয়া হয়েছিল উপস্থিত থাকার জন্য। তখন উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন সম্ভবত মহিম বাবু। প্রোগ্রামের নিমন্ত্রন পত্রটি নিজ হাতে আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন আরেক প্রবীণ রাজনীতিক সাবেক চেয়ারম্যান রামানন্দ বাবু। পরে ভিআইপি কার্ড নিয়ে মঞ্চের সামনে চেয়ারে বসতেই সামনে অলিউল চাচার পান ভর্তি মুখখানার হাসি দেখতে পাই। সভাশেষে বাজারে পেয়ে বললেন দাদার (বাবা) শরীর খারাপ নাকি ? আমিও আদাব জানিয়ে জলদি উত্তর দিলাম জানেন ওইতো বাবার আদর্শ!
২০০৯ সালে বাবার শয্যাগত অবস্থায় আমরা তিন ভাইয়ের মাঝে দুই ভাই দেশের বাহিরে। বড়দা বাবাকে নিয়ে সিলেট প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করালে অলিউল চাচা কোথা হতে খবর পেয়ে দৌড়ে ছুটেছিলেন বাবাকে দেখতে।

সেদিন শেষমেষ ভিডিও কলে যখন কথাহয় তখন ভারাক্রান্ত কন্ঠে তাঁর আকাঙ্ক্ষার কথা শোনালেন- “বাবারে তোমার বাবার মতো তো সারাজীবন রাজনীতি করলাম, মুক্তিযুদ্ধে ছোটাছুটি করলাম কিন্তু এখনো মুক্তিযুদ্ধের গেজেটে আমার নামটা তোলতে পারিনি”!

আজ অলিউল হক নেই,রয়েগেলো তাঁর আকাঙ্ক্ষা! যে মানুষটা দেশ গড়লেন,জীবন দিলেন, যৌবন দিলেন, পতাকা দিলেন, স্বপ্ন ছিল মৃত্যুরপর হলেও জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে সম্মানটুকু বহন করবেন অথচ রাষ্ট্রীয় কূটচাতুরীতে সেই পতাকা বহন করে স্বাধীনতা বিরোধী কালাইরা। শুধু কি তাই ? একজন আপাদমস্তক রাজনীতিক ব্রতীর ধর্মীয় উন্মাদনার কারনে হাতের রাজনীতির প্রদীপ যে নিভে দিলো সে কথা কি ভেবে দেখেছেন কেউ? হায় রে দেশ! হায় রে কপাল!

তবে তাঁর দীর্ঘ রাজনীতিক জীবনে যেটুকুই সময় ব্যায় করে গিয়েছেন তার সত্যসার হিসেবে উপনীত হওয়া যায় আওয়ামী আদর্শের প্রদীপ জ্বালিয়েছেন যেমন সত্যি আবার উনার পরিবার নিভিয়েছ্ন এটাও সত্যি । আর এর চেয়েও বড় সত্যি জ্বালানো হউক আর নেভানো হউক, তিনি আওয়ামী আদর্শের প্রদীপটি আমৃত্যু ধরে রেখেছিলেন।

লেখক ঃ সুশান্ত দাস
সদস্য,লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব,লন্ডন,যুক্তরাজ্য।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!