হাওর ডেস্ক::
বিদ্যুতের লোডশেডিং মোকাবিলায় কৃত্রিম আলোর ব্যবহারে প্রতি পূর্ণিমা রাতে নিভিয়ে ফেলা হতো স্ট্রিট লাইট। নব্বই দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের একটি পৌর শহরে পূর্ণিমা উপভোগে সেই অভিনব উদ্যােগটি বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হিসেবে প্রচার পায়। ১৯৯৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনের সুবাদে উদ্যোগটি ছড়িয়ে পড়ে দেশে ও বিদেশে। ‘আকাশ ভাইঙ্গা জোছনা পড়ে’ কথার প্রচলনে সেই থেকে শহরের নতুন পরিচিতি জলজোছনার শহর।
সুনামগঞ্জ শহরে প্রায় ২৭ বছর আগের সেই উদ্যোগকে উপজীব্য করে সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী তার জলোপাখ্যান সিরিজের ‘মউজ, মজে মউজ’ গ্রন্থে তুলে এনেছেন। বইটির প্রকাশক চৈতন্য প্রকাশন। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ঢাকায় একুশের বইমেলায় সর্বশেষ আকর্ষণ হিসেবে ২৭ ফেব্রুয়ারি বইটি চৈতন্য স্টলে আসছে।
সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী বাংলাদেশের জলাভূমির উপাখ্যান নিয়ে জলোপাখ্যান সিরিজ লিখছেন। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে তৃণমূলে দেখা ঘটনা অবলম্বন করে তার ধারাবাহিক লেখনির প্রথম গ্রন্থ ছিল ‘জলজীবিকার জলোপাখ্যান : বারকি, জন বারকি’। ২০২৩ সালের বইমেলায় এটি প্রকাশ হয়। জলোপাখ্যান সিরিজের দ্বিতীয় বই জলজোছনার জলোপাখ্যান : মউজ, মজে মউজ’। বইটির প্রচ্ছদ করেছেন খ্যাতিমান প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ। জলজোছনা-চিত্র এঁকেছেন নাওয়াজ মারজান। জলজোছনা সচিত্রকরণ করেছে জাতীয় পুরস্কার পাওয়া শিশুশিল্পী নওশীন আজিজ।
বইটির প্রকাশক চৈতন্য প্রকাশনের সত্ত্বাধিকারী রাজীব চৌধুরী বলেন, জলোপাখ্যান সিরিজের প্রথম গ্রন্থ ‘বারকি, জন বারকি’র কাহিনি ছিল ব্রিটিশ আমলের শুরুর দিকের একটি বাহনকে কেন্দ্র করে। যে কারণে বইটির প্রথম প্রকাশ ব্রিটেনে করা হয়েছিল। এই বইটির কাহিনি আমাদের দেখার মধ্যে। জলজোছনার রূপকার ছিলেন জোছনাবাদী কবি ও জনপ্রতিনিধি অকালপ্রয়াত মমিনুল মউজদীন। তাকে নিয়ে মউজ ও মজে থাকার জলজোছনা-কাহিনি। এ কাহিনি থেকে পূর্ণিমা রাতে শহরের স্ট্রিট লাইট নিভিয়ে চন্দ্রালোকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়ার শানিত আহবান প্রাধান্য পেয়েছে।
প্রকাশক জানান, জলোপাখ্যান লেখক প্রতিটি পর্ব শুরু করেছেন ‘জল’ শব্দটি দিয়ে। জলজোছনার কবি মমিনুল মউজদীনের কবিতার একটি লাইন- ‘হে আমার চৌতিরিশের ক্ষুব্ধ যৌবন’কে সীমারেখার মধ্যে রেখেছেন। ৩৪টি কবিতা, ৩৪টি চিত্র আর ৩৪টি ঘটনায় গাথা প্রায় ১৫ বছরের ঘটনাক্রম। উপাখ্যান সময় মাত্র ৩৪ সেকেন্ড। নতুন প্রজন্মের ৩৪ বছর বয়সীদের জোছনাবাদে বুঁদ হওয়ার কাব্যিক আহবান রয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। সাধারণ পাঠক ছাড়াও বইটির প্রতি প্রকৃতিপ্রেমিক, কবি ও কবিতা অনুরাগীদের পাঠ আকর্ষণ থাকবে।
বইটিতে ‘সূত্রপাত’, ‘জলজোছনার জলোপাখ্যান’ ও ‘সূত্র’ নামে তিনটি ভাগ রয়েছে। সূত্রের মধ্যে রয়েছে আরও তিনটি অধ্যায়। তাতে প্রথমেই রয়েছে নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের কথা। তিনি জোছনা প্রেমিকদের প্রশ্ন করে বলেছিলেন, ‘আপনি কি জানেন, বাংলাদেশে একটি জেলা শহর আছে যেখানে পূর্ণিমা রাতে রাস্তায় কোনো বাতি জ্বলে না? পূর্ণিমার আলো উপভোগের অভিনব উদ্যোগ। সুনামগঞ্জের পৌর চেয়ারম্যান মমিনুল মউজদীন জ্যোৎস্নাকে সম্মান জানাতে এ ব্যবস্থা নিয়েছেন।’
মরমী কবি হাসন রাজার প্রপৌত্র মমিনুল মউজদীন ২০০৭ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ ফেরার পথে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রী, এক পুত্র ও গাড়িচালকসহ নিহত হন। তার মৃত্যুর পর থেকে পৌর শহরে পূর্ণিমা রাতে স্ট্রিট লাইট নিভিয়ে জোছনা উপভোগের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের সেই উদ্যোগটি বন্ধ রয়েছে।
জলজোছনার জলোপাখ্যানের সূত্রপাত-কথায় লেখক সেই উদ্যোগটি ফেরানোর আকুতি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতিকে প্রকৃত রেখে চলতে পারাটা সংস্কৃতি। প্রকৃতি-সংস্কৃতিই সরলরেখা। এই রেখাপাতে বা সরলতার সারল্যে জন্ম নিয়েছিল জোছনাবাদ। যা কেবল লেখায় আঁকা দেখার বিষয়। কী চোখে দেখেছি? সেই দেখা বরণের পর হরণ এখন। হরণ আহরণে রক্তক্ষরণে বিষণœ তারুণ্য। বিষণœতার বিনাশে ফেরাতে হবে জোছনাবাদ। নগ্ন জলে মগ্ন আমি পারি, না-পারি-অগ্রগামী অন্য কোনো উজ্জ্বল মেহেদী পারবে। জলজোছনার শহরে একদিন জোছনাবাদ ফিরবে! ফেরার আনন্দে ফিরে যাতে অর্জুন চিনতে ফেরারি হতে না হয়, এজন্যই এই জলজোছনার জলোপাখ্যান-মউজ, মজে মউজ।’