বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার হিন্দু মুসলিম দুই ধর্মের দুই সাধকের আখড়া এখন মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। সীমান্ত নদী যাদুকাটার দুই তীরে প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকার গ্রামগুলো এখন লোকে লোকারণ্য। বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রী চৈতন্যের প্রধান সহকারি সাধকপুরুষ ও শ্রী অদ্বৈত আচার্যের নবগ্রামের মন্দিরে জড়ো হয়েছেন দেশ বিদেশের পূণ্যার্থীরা। তারা গঙ্গারূপী যাদুকাটা নদীতে পূণ্য¯œান করে পুতপবিত্র হচ্ছেন। ৬ এপ্রিল শনিবার সকাল ৭টা ৫২ মিনিট ১৬ সেকেন্ড থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১টা ৪৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ডের মধ্যে ¯œানের লগ্ন। প্রায় সাড়ে ৫শ বছরেরও অধিক সময় থেকে রেণুকা নদীতীরে পূণ্য¯œান করছেন পূণ্যার্থীরা। মায়ের মনোবাসনা পূরনের জন্য যোগসাধনা বলে পণ করে তীর্থ এনেছিলেন শ্রী অদ্বৈত আচার্য্য; তাই এটাকে পণাতীর্থও বলা হয়। নবগ্রাম যাদুকাটা নদী ভেঙ্গে নিয়েছে। এখন পাশের রাজারগাও গ্রামে অদ্বৈত মন্দির স্থাপিত হয়েছে। এখানেই বারুণী উৎসবের মূল আচারাদি পালিত হয়। পাশাপাশি পাশের গড়কাটি গ্রামেও ইসকন একটি বিশাল মন্দির করেছে। সেখানেও আচারাদি পালন করা হয়। দুটি মন্দিরে ও আশপাশে হাজার হাজার পূণ্যার্থী জড়ো হয়ে ভোর থেকেই ¯œান করছেন, পালন করছেন ধর্মীয় আচারাদি। ভারতের গয়া, কাশি, মথুরাসহ বিভিন্ন স্থান থেকেও অদ্বৈত ভক্তরা এসেছেন। প্রতি বছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে পূণ্য¯œান স¤ন্ন হয়ে থাকে এখানে। তবে একই সময়ে মুসলমানদের কাছে জিন্দাপির খ্যাত লোকসাধক শাহ আরেফিনের মাঝারেও শুরু হয়েছে ওরস। যেখানে হিন্দু মুসলমান বাউল ও মানুষের মিলনের গান পরিবেশন করছেন। শাহ আরেফিনের মাঝারেও মানত দিয়ে মনোবাসনা পূরণের প্রার্থনা করছেন হিন্দু মুসলমান। তবে লাখো মানুষের উপস্থিতির কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ আছে। পায়ে হেটে মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে পূণ্য¯œান সম্পন্ন করছেন পূণ্যার্থীরা।
শ্রী শ্রী অদ্বৈত মন্দির পরিচালনা কেন্দ্রীয় কমিটি সূত্রে জানা গেছে পঞ্চদশ শতকে লাউড়ের রাজা দিব্যসিংহের মন্ত্রী ছিলেন সাধক অদ্বৈতাচার্য্য পিতা কুবেরাচার্য্য। শাস্ত্রবিদ সুপ-িত ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী নাভা দেবী ১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম দেন অদ্বৈতাচার্য্যরে। কমলের মতো দেখতে সুন্দর বলে তার নাম রাখেন কমলাক্ষ। সন্তানের ৮ বছর বয়সে মা একদিন স্বপ্নে দেখেন তার কোলের শিশুটি শঙ্খচক্র গদাধারী মহাবিষ্ণু রূপী। সন্তানের এই রূপ দেখে তিনি মহাবিষ্ণরূপী সন্তানের সামনে আনত হয়ে চরণোদক প্রার্থনা করেন। পণ করেন গঙ্গা¯œানের। মায়ের স্বপ্নের বর্ণণা শুনে সন্তান পণ করেন নবগ্রামের প্রাচীন রেণুকা নদীতে পৃথিবীর সপ্ততীর্থÑগঙ্গা, যমুনা, নর্দমা, সরস্বতি, গোদাবেরি, কাবেরি ও সিন্দু নদীর জল একত্র করবেন। প্রার্থনা ও যোগসাধনা বলে তিনি তাই করেন। তীর্থজলে ¯œান করে পরিতৃপ্ত হন জননী। পণে তীর্থ আনেন বলে নাম হয় পণাতীর্থ। এই থেকেই লাউড়ে উৎপত্তি হয় এই পণাতীর্থের। এরপর থেকেই গঙ্গারূপী রেণুকা নদীর তীরে পণাতীর্থে আসছেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। ¯œান করে বিশুদ্ধ ও পাপমুক্ত হন তারা। মনোবাসনা পূরনের জন্য নানা উপকরণ ছিটিয়ে দেন। এসময় যাদুকাটা নদী তীরের প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মেলা বসে। এই মেলায় নানা ধরনের পণ্য নিয়ে উপস্থিত হন ব্যবসায়ীরা। বিকেলেই এই ব্যবসায়ীরা পসরা গুটিয়ে শাহ আরেফিনের আস্তানা লাউড়েরগড় সীমান্তে চলে আসেন। এখানেও কয়েক হাজার দোকান বসে।
শ্রী শ্রী অদ্বৈত মন্দির পরিচালনা কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, শুক্রবার সকাল থেকেই দেশ বিদেশের পূণ্যার্থীরা এসে পৌছেছেন। তারা নদী তীরের গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে অদ্বৈত মন্দির ও ইস্কন মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছেন। সারারাত দুটি মন্দিরে লীলা সংকীর্তন হয়েছে। ধর্মগুরুরা ধর্মীয় বাণী প্রচার করেন। সাধক অদ্বৈতের জীবন ও সাধণার কথা প্রচার করেন। মঙ্গল আরতি, ভজন লীলা, কীর্তন, গঙ্গাপূজাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়েছে।
তিনি বলেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকেও পূণ্যার্থীরা এসেছেন। তাদেরকে আমরা মন্দিরে আশ্রয় দিয়েছি। দেশ বিদেশের প্রায় লক্ষাধিক পূণ্যার্থী এবার পূণ্য¯œান সম্পন্ন করেছেন। তারা যাতে নির্বিঘেœ ¯œান ও আচারাদি শেষ করে যেতে পারেন এ কারণে প্রশাসনও বিভিন্ন স্তরের নিরাপত্তা দিচ্ছে। যানবাহনেও শৃঙ্খলা আনা হয়েছে। যাতে কেউ অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করতে না পারে সেজন্য প্রশাসন সক্রিয় আছে। পথে পথে কয়েকশ স্বেচ্ছাসেবী আগত ভক্তবৃন্দকে নানাভাবে সহযোগিতা করবেন। শনিবার সকাল ৭টা ৫২ মিনিট ১৬ সেকেন্ড থেকে শুরু হয়ে দুপুর ১টা ৪৯ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে পূণ্য¯œানের লগ্ন নির্ধারিত হয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাজন কুমার দাস বলেন, পুলিশ, আনসার ও বিজিবির নেতৃত্বে চারটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছে ২ জন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত রয়েছে। পথে পথে রয়েছে শাদা পোষাকধারী আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। আব্দুজ জহুর সেতু থেকে বারুণী স্থল পর্যন্ত তিন স্তরের নিরাপত্তা নেওয়া হয়েছে। যাতে পূণ্যার্থীরা নির্বিগ্নে আচারাদি পালন করতে পারে। অন্যদিকে শাহ আরেফিনের ওরসও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে।
বারুণী ¯œান শেষ করে ওইদিন সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় মুসলিম ধর্মের সাধক ও লোকায়ত পির হযরত শাহ আরেফিনের ওরস। রাতভর দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শাহ আরেফিন ভক্তরা বাউল গান পরিবেশন করবেন। মানবধর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন তারা। গানে গানে প্রভুকে ডাকবেন। তবে এখানেও হিন্দু ধর্মাবলম্বিসহ অন্যান্য ধর্মের লোকজনও শাহ আরেফিনের মোকামে এসে প্রার্থনা করেন। মনোবাসনা পূরণের জন্য মানতের বস্তু দান করেন। তাই এ উপলক্ষে মিলনোৎসবে রূপ নেয় এলাকা। বসে বিরাট মেলা। যেখানে স্থানীয় উৎপাদিত পণ্যসহ নানা ধরনের পণ্য পাওয়া যায়।
শাহ আরেফিন মাঝার ও ওরস উদযাপন কমিটির সদস্যসচিব আল সাব্বির বলেন, ওরসে প্রায় লক্ষাধিক শাহ আরেফিন ভক্ত আসতে শুরু করেছেন। তারা মাঝারের আশপাশে গানে মশগুল হয়েছেন। মানত পূরণে দানদক্ষিনা করছেন। এছাড়াও সাধক অদ্বৈত ভক্তরাও এখানে এসে শাহ আরেফিনের দরশন দিয়ে যাচ্ছেন। দুই ধর্মের দুই সাধকের অনুষ্ঠান উপলক্ষে মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে পুরো এলাকা। মানুষের এই সম্মিলনের ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে চাই।
শ্রীমঙ্গল থেকে মাতা পিতার অস্থি বিসর্জন দিতে পণাতীর্থে সপরিবারে এসেছেন চম্পাকলি পাল। তিনি বলেন, দুর্গম যোগাযোগ মাড়িয়ে আমি বোন ও ভাইকে নিয়ে এসে ¯œান করেছি। অস্থি বিসর্জন করে পিতা মাতার আতœার শান্তি কামনা করেছি। মনোবাসনা পূরণের জন্য মানত দিয়েছি। তবে পণাতীর্থে যাবার রাস্তাটি বড়ো করলে ভক্তদের কষ্ট লাগব হতো বলে জানান তিনি।
জগন্নাথপুরের বেতাউকা গ্রামের আব্দুল মজিদ বলেন, আমার হিন্দু বন্ধুরা এসেছে পূণ্য¯œানে। আমি তাদের সঙ্গে এসে দেখেছি লাখো মানুষ পূণ্য¯œান করছে। পরে তারা আমার সঙ্গে সাধক শাহ আরেফিনের মাঝারে এসে দরশন দিয়েছে। অসাম্প্রদায়িক মিলনমেলায় মেতেছে সীমান্ত এলাকা।