হাওর ডেস্ক::
পরিবর্তনে ওলটপালট হয়েছে পৃথিবীর আবহাওয়ার চরিত্র। মরুভূমির বুকে অসময়ে হচ্ছে শীলাবৃষ্টি-বন্যা। নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে বৈশাখের শুরুতেই তীব্র দাবদাহে ওষ্ঠাগত মানুষের প্রাণ। তপ্ত মরুর দেশগুলোতে যখন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হচ্ছে ২৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তখন বাংলাদেশে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই। এই তাপপ্রবাহ আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। ইতোমধ্যে বৈশাখের ২০ দিন পার হলেও স্বাভাবিক ঝড়বাদল বা কালবোশেখির দেখা তেমন মেলেনি। অন্যদিকে গরম তীব্র থেকে অতিতীব্র আকার ধারণ করছে। বিভিন্ন এলাকায় বইছে মৃদু থেকে অতিতীব্র তাপপ্রবাহ। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। তাপপ্রবাহের কারণে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সাত দিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হিট অ্যালার্ট জারি করেছে আবহাওয়া অধিদফতর। জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে বা হিটস্ট্রোকে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায় গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। দেশের ১২টি জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায় গতকাল। এর মধ্যে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় যশোর, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা, কুষ্টিয়ার কুমারখালী, বাগেরহাটের মোংলা, পাবনার ঈশ্বরদী ও রাজশাহীতে। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশেই গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এর মধ্যে ওমানে ৩০য ডিগ্রি, কাতারে ৩২ ডিগ্রি, সিরিয়ায় ২৮ ডিগ্রি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৯ ডিগ্রি, বাহরাইনে ৩২ ডিগ্রি, ইরানে ২৬ ডিগ্রি এবং সৌদি আরব, কুয়েত ও ইরাকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদিও মরুভূমির তপ্ত বালুর এই দেশগুলোতে এক সময় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরেও তাপমাত্রা রেকর্ড হতো। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ওমানে ৫৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। ২০২০ সালের ৩০ জুলাই কুয়েতের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৫২.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সৌদিতে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ২০১০ সালের ২২ জুন। এদিকে গত ১৬ এপ্রিল স্মরণকালের রেকর্ড বৃষ্টিপাতে নজিরবিহীন বন্যায় তলিয়ে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাই শহর। বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যস্ততম বিমানবন্দর। ২৪ ঘণ্টার অস্বাভাবিক বৃষ্টিতে সড়কে জমে যায় বুকসমান পানি। শপিং মলের মধ্যে হাঁটুসমান পানি ঢুকে যায়। মরুর দেশে এপ্রিল মাসে এমন বৃষ্টিতে দেখা দিয়েছে বিস্ময়। যেখানে আরব আমিরাতে বছরে ১৫০-২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়, সেখানে ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টিপাত হয় ২০০ মিলিমিটার। এদিকে বাংলাদেশে যখন তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে, তখন দুবাইয়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাতের বেলায় তাপমাত্রা নামছে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। দুবাই সফররত বাংলাদেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামসাদ হুসাইন তানভীর ফেসবুকে লিখেছেন, সেখানে এসি চালাতে হচ্ছে না। একটি ফ্যান চালালেও কমফোর্টার গায়ে দিয়ে ঘুমাতে হচ্ছে। গবেষণা বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে তাপমাত্রার চরিত্র বেশি বদলাচ্ছে। এ অঞ্চলে গত ২০০ বছরের তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙে গত বছরের এপ্রিল-মে মাসে। থাইল্যান্ডের ইতিহাসে ১৫ এপ্রিল ছিল সবচেয়ে উষ্ণতম দিন। তাপমাত্রা ছিল ৪৫.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১ জুন ভিয়েতনামের ইতিহাসেও রেকর্ড ভেঙে তাপমাত্রা দাঁড়িয়েছিল ৪৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ছিল ভিয়েতনামের ইতিহাসে সবচেয়ে উষ্ণতম জুন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ছয়টি দেশে এমন ঘটনা ঘটে। চলতি বছর তাপমাত্রার ওই রেকর্ডও ভাঙতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়া এমন বিরূপ আচরণ করছে। খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, তাপপ্রবাহ, শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিচ্ছে। আর্দ্র এলাকাগুলো শুষ্ক হয়ে যাচ্ছে, আবার শুষ্ক এলাকায় বৃষ্টিপাত বাড়ছে। কখনো শীতকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে, কখনো ছোট হয়ে যাচ্ছে। কখনো অতিবৃষ্টিতে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আবার কখনো খরায় মাটি ফেটে যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী না হয়েও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ।
আরও বাড়বে গরম : আবহাওয়াবিদরা বলছেন, চলমান তাপপ্রবাহ আগামী ৩০ তারিখ পর্যন্ত চলবে। দেশের কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বৃষ্টি হলেও কমবে না তাপমাত্রা। বাতাসে জলীয় বাষ্পের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় গরম বেশি অনুভূত হবে। মাসজুড়েই এ অবস্থা থাকবে। সারা দেশের তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠানামা করতে পারে। গতকাল আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদেনে তাপপ্রবাহের বিষয়ে বলা হয়েছে- যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলায় অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী ও পাবনা জেলাসহ খুলনা বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং ঢাকা বিভাগের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ এবং ময়মনসিংহ, মৌলভীবাজার, ফেনী, কক্সবাজার, চাঁদপুর ও রাঙামাটি জেলাসহ রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশে ও বরিশাল বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে; তা অব্যাহত থাকবে। আবহাওয়াবিদ কাজী জেবুন্নেসা বলেন, শনিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ১৯৬৪ সালে যশোরে ৪৪ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছিল। তিনি বলেন, শনিবার ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গত বছর ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ধারণা করা হচ্ছে এ বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্পর্শ করতে পারে রাজধানী ঢাকায়। গত বছর ১৭ এপ্রিল ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উঠেছিল।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, কোনো বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি থাকলে মৃদু, ৩৮ থেকে ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি থাকলে মাঝারি ও ৪০ থেকে ৪১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তীব্র এবং ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকলে তাকে অতিতীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়।
হিটস্ট্রোকে তিনজনের মৃত্যু : পাবনা শহরে ৬০ বছর বয়সী সুকুমার দাস নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। অতিরিক্ত গরমে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া চুয়াডাঙ্গায় হিটস্ট্রোকে জাকির হোসেন (৩৩) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে তিনি মাঠে গেলে হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। গাজীপুরের কোনাবাড়ি থানাধীন জেলখানা রোডের জমিদার মাঠ থেকে সোহেল রানা (৪২) নামে একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তীব্র তাপদাহের কারণে হিটস্ট্রোকে তার মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করছে এলাকাবাসী। কয়েকদিন ধরে ভারসাম্যহীন অবস্থায় কোনাবাড়ি এলাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন সোহেল।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ১৭ এপ্রিল ৯ বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ঈশ্বরদীতে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। তার আগে ২০১৪ সালের মে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৪৩ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে বছরের ১৬ এপ্রিল আগের ৫৮ বছরের মধ্যে ঢাকার তাপমাত্রা ছিল সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৭৫ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এখনো ভাঙেনি।