বিশেষ প্রতিনিধি::
‘আউরের মানুষ বালা নাই। ধান নিছে পাইন্যে। গরু বেইচ্যা খাইছে। অনেকে ঘাস না পাইয়াও গরু ফস্তায় বেচছে। এখন গিরস্তের গোয়ালঘর শূন্য। কোরবানি দিব কিবা। তাই ইবার আর বাড়িত গিয়া ঈদ করতামনা। কোরবানি দিতে পারতামনা বাড়িত গিয়া কি খরমু’। (হাওরের মানুষ ভালো নেই। ধান নিয়েছে পানি। গরু বিক্রি করে খেয়েছে।
ঘাস না পেয়ে অনেকে গরু সস্তায় বিক্রি করছে। এখন কৃষকের গোয়ালঘর শূন্য। কোরবানি দিবে কিভাবে। এ বছর কোরবানি দিতে পারব না, তাই বাড়িতে গিয়ে ঈদ করব না। )
কথাগুলো বলছিলেন ধর্মপাশার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের বাবুপুর গ্রামের সচ্ছল কৃষক পরিবারের সন্তান মোশফিকুর রহমান স্বপন। একটি ওষুধ কম্পানির কর্মী স্বপন এখন সপরিবারে সুনামগঞ্জ শহরে বাস করেন। ফসলহারা কৃষক পরিবারের এই সন্তান স্ত্রী ও তিন সন্তানকে নিয়ে এবার শহরেই নীরবে ঈদুল আজহা পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
শুধু স্বপনই নন, ফসল হারিয়ে এখন হাওরের অবস্থাসম্পন্ন কৃষকও খাদ্যসংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। গোয়ালের গরু বিক্রি করে এত দিন চলেছেন তাঁরা। গবাদি পশুর খাদ্যও ধানের সঙ্গে তলিয়ে যাওয়ায় খাবারের অভাবে অনেক কৃষক শুরুতেই গবাদি পশু জলের দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন কোনোমতে দিনপার করছেন তাঁরা। কোরবানি তাঁদের কাছে দুঃস্বপ্ন। সচ্ছল কৃষকরা কোরবানি দিতে না পারায় প্রতিবেশী হতদরিদ্র লোকদেরও এবার পেট ভরে কোরবানির মাংস খাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন।
কৃষকরা জানান, প্রতিবছর ঈদুল আজহা উৎসব করে পালন করেন হাওরের মুসলমান সম্প্রদায়ের কৃষকরা। বৈশাখের ধান তোলা শেষ হলে বাছাই করে একটি গরু কোরবানির জন্য আলাদাভাবে পরিচর্যা করেন। ঈদের দিনে সেই গরুটি কোরবানি দিয়ে আশপাশের দরিদ্র মানুষদের মধ্যেও বিলিয়ে দেন। অপুষ্টি আর সারা বছর মাংস খাওয়া থেকে বঞ্চিত দরিদ্র সম্প্রদায়ের লোকজন এই সুযোগে পেটপুরে কয়েক বেলা মাংস খাওয়ার সুযোগ পায়। তা ছাড়া আরো দুই-তিনটি গরু ঈদ উপলক্ষে বিক্রি করার জন্য আলাদাভাবে পরিচর্যা করতেন কৃষকরা। কিন্তু এবার ফসলহানির প্রভাব পড়েছে কোরবানিতে। কৃষকরা কোরবানি দিতে না পারায় এটা থেকে বঞ্চিত হবেন তাঁরা। জানা গেছে অনেক অবস্থাসম্পন্ন কৃষক অন্য বছর একসঙ্গে দুই-তিনটি গরু কোরবানি দিতেন। এবার একটি কোরবানি দিতে গিয়েই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে সুনামগঞ্জে প্রায় আড়াই লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে সচ্ছল ও মাঝারি কৃষক পরিবারের সংখ্যা লাখেরও উপরে। কৃষকদের মতে এই শ্রেণির কৃষকরাই প্রতি বছর কোরবানি দিয়ে থাকেন।
দিরাই উপজেলার তাড়ল গ্রামের কৃষক আনহার মিয়া বলেন, হাওরে প্রতিবছর কোরবানির ঈদ খুশি নিয়ে আসে। গৃহস্থরা আগে থেকেই কোরবানির জন্য প্রস্তুত থাকেন। কিন্তু এবার সেই টান নেই। বরং বেঁচে থাকার জন্যই এখন তাঁদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে। কোরবানি দেওয়াটা দুঃস্বপ্নের মতো।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের কিষানি নাসিমা আক্তার বলেন, ‘বৈশাখ মাইর যাওয়ায় ইবার গরিবরাও ধান খাটতে পারছে না। খানি নাই তাদের ঘরো। আমরার হাইরের ধনী গিরস্তরাও ইবার কোরবানি দিতো পারতো না। তারাই চলতো পারের না। তাই ইবার মাংস খাইতাম পারতামনা আমরা গরিবরা। ’
ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সব জমির ফসল তলিয়ে গিয়েছিল। আমাদের ক্ষেতের ওপর নির্ভরশীল প্রায় শতাধিক পরিবার এবার নিঃস্ব। অন্যবার দুই-তিনটি কোরবানি দিতে পারলেও এবার কোনো রকমে একটি পশু কোরবানি দিতে পারব। ফসল হারানোর কারণে হাওরের সব গ্রামের সচ্ছল কৃষকরা এবার কোরবানি থেকে বঞ্চিত হবেন বলে তিনি জানান। ’