হাওর ডেস্ক::
শুরুতে মনে হচ্ছিল, ছক্কা হয়েই যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বল জমা পড়ল সীমানায় এইডেন মার্করামের হাতে। হতাশায় মাথায় হাত দিয়ে কাতর চোখে তাকিয়ে রইলেন ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ। ফুল টস বলটি কাজে লাগাতে না পেরে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তিনি। শরীরটাকে কোনোরকমে টেনে নিচ্ছিলেন ড্রেসিং রুমের দিকে। গ্যালারিতেও তখন অসংখ্য মানুষের মাথায় হাত। একটু আগেই যে গ্যালারি ছিল উত্তাল, সেখানেই তখন হাহুতাশের স্রোত।
যে ম্যাচ ছিল মুঠোয়, সেটিই ফসকে গেল মাহমুদউল্লাহর ওই আউটে। শেষ বলেও সম্ভাবনা ছিল বটে। তবে সেটা তো ছিল স্রেফ লটারি, যেখানে সবকিছু মিলে যায় কালেভদ্রে। এবারও মেলেনি এবং বাংলাদেশ পারেনি। যে ম্যাচ জয়ের খুব কাছে ছিল বাংলাদেশ, সেই ম্যাচেই শেষ পর্যন্ত সঙ্গী ৪ রানের হার। অ্যাডিলেইডের ভূত যেন ফিরে এলো নিউ ইয়র্কে!
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে অ্যাডিলেইডে একটি ফেইক ফিল্ডিংয়ের ঘটনা ছিল ভিরাট কোহলির। কিন্তু তা চোখ এড়িয়ে যায় আম্পায়ারের। নিয়ম অনুযায়ী, ফেইক ফিল্ডিংয়ের সাজা ৫ রান জরিমানা। সেটি প্রাপ্য হলেও পায়নি বাংলাদেশ। পরে তারা ম্যাচ হেরে যায় ঠিক ৫ রানেই। এবার আম্পায়ার ভুল সিদ্ধান্ত আর নিয়মের খাড়ায় একটি লেগ বাই বাউন্ডারি পায়নি বাংলাদেশ দল। শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে সোমবার তারা হেরে গেল ওই ৪ রানেই।
সপ্তদশ ওভারে ওটনিল বার্টম্যানের একটি ডেলিভারি মাহমুদউল্লাহর পায়ে ছোবল দিয়ে চলে যায় বাউন্ডারিতে। তবে বল সীমানা ছাড়ানোর বেশ আগেই এলবিডব্লিউর আবেদনে আঙুল তুলে দেন আম্পায়ার। রিভিউয়ে দেখা যায়, বল চলে যেত লেগ স্টাম্পের বেশ বাইরে দিয়ে। মাহমুদউল্লাহ তাই টিকে যান। কিন্তু নিয়ম বলছে, আম্পায়ার আউট দেওয়া মাত্রই বল ‘ডেড’, কাজেই লেগ বাই চার রান হিসেবের বাইরে।
চার রানে হেরে যাওয়া ম্যাচে এরকম একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবেই। তা হচ্ছেও। সামাজিক মাধ্যমে আম্পায়াদের মুণ্ডুপাত চলছে। সংবাদ সম্মেলনও এ নিয়ে প্রশ্ন হলো। তাওহিদ হৃদয় তো বেশ খোলামেলাভাবেই কাঠগড়ায় তুললেন আম্পায়ারদের। ‘সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল’ সরাসরিই এমনটি বলার পাশাপাশি তার নিজের ‘আম্পায়ার্স কল’ আউট, দুটি ওয়াইড না পাওয়ার দাবিসহ কড়া সমালোচনা করলেন তিনি আম্পায়ারদের। সংবাদ সম্মেলনে এভাবে আম্পায়ারিং সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রকাশ্যে আপত্তি জানানো সচরাচর দেখা যায় না। দলের প্রতিনিধি হয়ে তিনি সংবাদ সম্মেলনে এসেছেন, ধারণা করা যায়, দলের ক্ষোভই ফুটে উঠছে তার কথায়।
বোলিংয়ে বাংলাদেশ দারুণ করলেও ব্যাটিংয়ে ব্যর্থ আবারও।
সেই ক্ষোভের কারণও অনুমেয়। পেশাদার হলেও তাদের আবেগ আছে, অনুভূতি আছে, ভাবনা আছে, প্রতিক্রিয়া প্রকাশের তাড়না আছে। এসব দিনে অনেক কিছু উগড়ে দিতেই পারেন। কিন্তু সময় যখন গড়াবে, স্নায়ু যখন থিতু হবে, আবেগের রেশ কমে গিয়ে যুক্তিরা মাথা তুলতে শুরু করবে, ম্যাচে ফিরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করবেন তিনি ও তারা, সবাই অনুভব করবেন, দিন শেষে বড় একটা সুযোগ তারা হাতছাড়া করেছেন এবং সেই দায় তাদেরই।
টপ অর্ডারের আরেকটি ব্যর্থতা, প্রতিপক্ষের সবচেয়ে বিপজ্জনক বোলার আনরিক নরকিয়াকে পুল করতে গিয়ে নাজমুল হোসেন শান্ত ও সাকিব আল হাসানের উইকেট বিলিয়ে আসা, আম্পায়ারিং সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক, সবকিছুর পরও তো শেষ ১৮ বলে কেবল ২০ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। উইকেট বাকি তখনও ৬টি। তাওহিদ হৃদয় তখন দারুণ খেলছেন, মাহমুদউল্লাহও সাবলিল। জুটি পঞ্চাশের কাছে। জয়টা কেবলই সময়ের ব্যাপার।
কিন্তু সময়ের থাবায় উল্টো ভেঙে পড়ল ইনিংস। গুঁড়িয়ে গেল আশা।
হৃদয় আউট হলেন আম্পায়ার্স কল-এ। যে সিদ্ধান্ত নিয়ে হৃদয় নিজে সংবাদ সম্মেলনে খানিকটা প্রশ্ন তুললেন, বাংলাদেশ দলও হয়তো একইভাবেই ভাবছে। তবে এর চেয়েও হালকা কিংবা সূক্ষ্ম ছোঁয়া স্টাম্পে লাগার পরও আম্পায়ার্স কল-এ ব্যাটসম্যানদের আউট হওয়ার নজির তো অহরহই দেখা যায়। এখানে আপত্তিটা তাই পরাজয়ের হতাশার ঝাপটা বলেই মনে হয়।
এমনকি শেষ ওভারে যখন প্রয়োজন ১১ রান, বোলিংয়ে কেশাভ মহারাজ, সুযোগ তো তখনও ছিল। স্নায়ুর চাপে পড়েই হয়তো, তিনটি ফুল টস করেছিলেন বাঁহাতি এই স্পিনার। তা কাজে লাগাতে পারেননি জাকের আলি, মাহমুদউল্লাহ ও তাসকিন আহমেদ। মাহমুদউল্লাহ তো ফুল টসে আউট হয়ে সম্ভাবনাই শেষ করে এলেন দলের। আসরের প্রথম ম্যাচে দাসুন শানাকার ফুল টসে তার ছক্কাই দলকে জয়ের দুয়ারে নিয়ে গিয়েছিল। এবার উল্টো স্বাদও পেলেন তিনি দ্রুতই।
কাজেই আম্পায়ারিং বিতর্কের পরও বাংলাদেশের সুযোগ ছিল। একটি-দুটি নয়, বেশ কিছু সুযোগই ছিল। কিন্তু শেষ সময়ে স্কিল ও স্নায়ুর পরীক্ষায় পেরে ওঠেনি কেউই।
তাতে দল নিশ্চয়ই হতাশ। তবে মাঠে থাকা দর্শকদের হতাশার তুলনীয় হয়তো কিছু নেই। সকাল থেকেই এদিন মাঠের চারপাশে ছিল লাল-সবুজের স্রোত। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে এক শতাংশ লোকও ক্রিকেটের কবর রাখেন কি না, এটা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। কিন্তু এ দিন আইসেনহাওয়ার পার্ক ও নিউ ইয়র্কের নাসাউ কাউন্টি এলাকা ছিল ক্রিকেটময়।
বাংলাদেশের জার্সি গায়ে, পতাকা নিয়ে, ব্যানার-প্ল্যাকার্ড হাতে হাজার হাজার দর্শক মাঠে আসেন বাংলাদেশের খেলা দেখতে। নিউ ইয়র্ক তো বটেই, অনেক দূরের রাজ্য ও শহর থেকেও অনেকে খেলা দেখতে আসে অফিস-ব্যবসা-পরিবার সামাল দিয়ে ও অনেক ঝামেলা পোহানোর পর। ৩৪ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার স্টেডিয়ামে এ দিন আনুষ্ঠানিক হিসেবে দর্শক ছিল ২২ হাজার ৬৫৮ জন। তাদের মধ্যে ৫৮ জনও দক্ষিণ আফ্রিকার সমর্থক ছিলেন কি না সন্দেহ আছে। গ্যালারিতে ছিল লাল-সবুজের জোয়ার। ম্যাচজুড়ে স্লোগানে-উল্লাসে দলকে উজ্জীবিত করে যান তারা। ৪০ ওভারের ম্যাচের প্রায় পুরোটা সময়ই তাদের গর্জনে চারপাশ ছিল প্রকম্পিত।
কিন্তু শেষ দিকে তারা মিইয়ে যান। আশাগুলো রূপ নেয় শঙ্কায় এবং শেষ পর্যন্ত চরম হতাশায়। খুশির ঝিলিক নিয়ে বাংলাদেশের জয় দেখতে আসা মানুষগুলো বিদায় নেয় হারের আঁধারকে সঙ্গী করে। লাল-সবুজের জার্সির ভেতরে মানুষগুলো তখন বেদনার নীল ছোবলে ক্শত-বিক্ষত। আইসেনহাওয়ার পার্কের সবুজ বনানীও তখন ভীষণ ম্লান আর ফ্যাকাশে।