বিশেষ প্রতিনিধি::
গত কয়েকদিন ধরে মেঘালয়ের ভারী বর্ষণের পানি পাহাড়ি ঢল হয়ে নামছে ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জে। ২০২২ সালের ১৭ জুনের ভয়াবহ মহাপ্লাবনের কথা স্মরণ করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন মানুষজন। বুধবার সকালে সুনামগঞ্জের ছাতক শহরের ৭০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জ শহরের প্রায় ৫০ ভাগ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। সুনামগঞ্জের ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে চেরাপুঞ্জির অবস্থান। সেখান থেকে পানি নেমে আসতে ছাতক ও দোয়ারাবায় ৪ ঘন্টা এবং সুনামগঞ্জে আসতে ৬ ঘন্টা সময় লাগে। এই ঢলের পানিই উদ্বেগের কারণ বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
ঈাহাড়ি ঢলের পানিতে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার সীমান্ত এলাকার গ্রাম/সড়ক প্লাবিত হয়েছে। গত দুদিন ধরে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন এলাকার গ্রাহকরা বিদ্যুৎহীন আছেন। এদিকে পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে ছাতক-সিলেট সড়ক ডুবে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ, তাহিরপুর-বিশ^ম্ভরপুর, জানিগাও জয়নগর, সুনামগঞ্জ-দোয়ারাবাজার সড়কে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহরের বিভিন্ন সড়কে এখন নৌকা চলছে। বন্যার্ত মানুষজন স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে ওঠেছেন।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদা জানান, সুনামগঞ্জে গত ২৪ ঘন্টায় ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার এবং ছাতকে একই নদীর পানি ১৫৫ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও যাদুকাটা, চলতি, সোমেশ^রী, খাসিয়ামারা, পুরাতন সুরমাসহ অন্যান্য নদনদীর পানি বাড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে তিনি জানান, আমাদের এলাকায় বৃষ্টিপাত কম হলেও মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। গতকাল সকাল ৯টা থেকে আজ বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩৯৫ মিলিমিটার। এর আগের দিন ১২৬ মিলিমিটার এবং এর আগের দিন ৪৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এছাড়াও আজ ভারী বর্ষণ অব্যাহত আছে। উজানের বর্ষণের এই পানিই ৬ ঘন্টার মধ্যে নেমে আসে। যার ফলে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট প্লাবিত হয় এবং সীমান্ত এলাকার রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী জানান, প্রতিটি উপজেলায় আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। দেওয়া হয়েছে ত্রাণ, শুকনো খাবার ও নগদ টাকা। এছাড়াও আরো ত্রাণের জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে আবেদন জানানো হয়েছে। সুনামগঞ্জ ও ছাতকের বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে বন্যার্ত লোকজন আশ্রয় নিয়েছে বলে জানান তিনি। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রশাসনের প্রস্তুতি রয়েছে বলেও জানান তিনি।
সুনামগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ারুল ইসলাম প্রাং বলেন, বন্যার কারণে ছাতক-সিলেট-গোবিন্দগঞ্জ সড়ক বন্ধ আছে। তাছাড়া সুনামগঞ্জ জামালগঞ্জ সড়কও বন্ধ আছে। বন্যায় অন্যান্য সড়কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বলেন, সড়ক বিভাগ বাদেও অন্যান্য দফতরের আভ্যন্তরীণ সড়কও প্লাবিত হয়েছে।
সুনামগঞ্জ-৫ আসনের এমপি মুহিবুর রহমান মানিক বলেন, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দোয়রাবাজার ও ছাতক উপজেলা। খাসিয়ারামা নদীর বেড়িবাধ ভেঙ্গে সীমান্তের কয়েকটি ইউনিয়নের বাড়িঘর রাস্তাঘাট ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আজ সকালে ছাতক শহরের ৭০ ভাগ ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে আরো ক্ষয়-ক্ষতি হবে। আমি প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের আশ্রয় কেন্দ্রে লোকজন পাঠানো ও বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর আবেদন জানিয়েছি।
হাওর আন্দোলনের সংগঠক সালেহীন চৌধুরী শুভ বলেন, চেরাপুঞ্জির অবস্থান ছাতক-দোয়ারার মাথার উপর। বৃষ্টি হলেই কয়েক ঘন্টায় পানি নেমে যায়। আগে সীমান্ত নদী প্রবাহমান ছিল, সুরমা নদীরও পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি ছিল। কিন্তু এখন নদী ভরাট এবং যত্রতত্র বাধা ও রাস্তা নির্মাণ করার ফলে পানির আধার কমেছে। এতে ঢলের পানি বাধা পেয়ে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাটের ক্ষতি করছে। মূলত মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিই সুনামগঞ্জের বন্যার জন্য দায়ি বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জের মধ্যবাজারের ব্যবসায়ী শুভ বণিক বলেন, সুনামগঞ্জে শহরের ৫০ ভাগের বেশি এলাকার রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। পুরো মধ্যবাজার, পশ্চিমবাজার, সাহেববাড়ি ঘাট, উকিলপাড়া, কাজির পয়েন্ট, নবীনগর, বড়পাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ডুবে গেছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন বানভাসী মানুষেরা। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ শহরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত খালগুলো উদ্ধার করে খনন করা হলে পানিনিষ্কাশন সহজ হতো।
স্থানীয়রা জানান, সুনামগঞ্জ ও ছাতক শহরে সকাল থেকেই পানি ডোকছে। সরেজমিন বুধবার দুপুরে সুনামগঞ্জ বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, খাদ্যগুদাম, সার গোদামে গিয়ে দেখা যায় গুদামের সংরক্ষিত কক্ষের নিচে পানি। সামান্য পানি বাড়লেই গুদামে সংরক্ষিত খাদ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ খাদ্য গুদামের সংশ্লিষ্টরা।