হাওর ডেস্ক::
“আমরা নিজির টাকা খরচ করে বস্তা ফেলাইছি। বাঁশ দিয়ে পরেত নিয়ে ঠিক করেও পানির সাথে পারি নাই। ২০ বছরের ভিতর পাঁচবার বাড়ি ভাঙছি নদীতি। এহুন আমরা কোনে যাবো, কেউ জমি দেচ্ছে না আমাদের।”
আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের ভাঙন কবলিত ৭ নম্বর ফেরিঘাট সংলগ্ন সাত্তার মেম্বার পাড়া এলাকার বাসিন্দা রিনা খাতুন।
তিনি বলেন, “বাড়িঘর ভাঙে পালা দিয়ে রাখছি বাড়িতেই কিন্তু আমাদের কেউ জাগা দিচ্ছে না। আমাদের কাছে মেম্বার-চেয়ারম্যানও আসতেছে না। অনেক মানুষের হাতে-পায়ে ধরতেছি কিন্তু কেউ জাগা দিতে চাচ্ছে না।”
রিনা খাতুন বলেন, “কয়দিনের ভাঙনে আমার ঘরের কাছে নদী চলে আইছে। রান্নাঘর নদীতে চলে গেছে। ভাঙন এ্যম্মা থাকলি শোয়ার ঘরটিও যেকোন সময় নদীতে চলে যাবি। এহন আমি কনে যাব সেই চিন্তাই করছি। টাকা-পয়সা নাই যে জমি রাহে বাড়ি করব।”
সরজমিনে দৌলতদিয়ার সাত্তার মেম্বার পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পদ্মায় পানি বাড়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ৭ নম্বর ফেরিঘাটের পূর্ব পাশে পন্টুন থেকে ১০ ফুট দূরেই ভাঙন রোধে বালুভর্তি ব্যাগ ফেলছেন কয়েকজন শ্রমিক।
তারা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নির্দেশে বালুভর্তি ব্যাগগুলো নদীতে ফেলছেন। এদিকে ৭ নম্বর ফেরিঘাটের পশ্চিম পাশেও ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েক দিনের ভাঙনে বেশ কয়েকটি পরিবারের ঘরের কোণে নদী চলে এসেছে।
কয়েক জনের বসতঘর থাকলেও রান্নাঘর নদীতে ভেঙে গেছে। কেউ কেউ বাড়ির গাছগুলো কেটে ফেলছেন, যাতে গাছগুলো নদীতে বিলীন হয়ে না যায়।
ভাঙন ঝুঁকিতে থাকা পরিবারের মানুষদের চোখেমুখে রয়েছে চাপা কষ্টের ছাপ।
এ ছাড়া ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে দৌলতদিয়ার ৩, ৪ ও ৬ নম্বর ফেরিঘাটসহ কয়েকশ বসতবাড়ি।
৭ নম্বর ফেরিঘাটের পূর্ব পাশেই বাড়ি ইদ্রিস প্রামাণিকের। তিনি বলেন, “নদীতে ভাঙে সব চলে যাচ্ছে। এহন দেখছি বস্তা ফেলাচ্ছে, ক্যা বস্তা পানি কমার সময় ফেলালে কী হয়? পানি যহন বাড়ে তহন বস্তা ফেলায়। পানি কমার সুময় যদি বস্তা ফেলায় তালি ভাঙন হয় না; কিন্তু বস্তা ফেলায় পানি বাড়ার সুময়। কোনো কামেই আসে না।”
পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা রশিদ মোল্লা বলেন, “আমাদের বার বার ভাঙতেইছে। আমাদের নদী তো শাসন হতেছে না। এই যে দুই-এক বস্তা যাই দেয় তা তো থাহে না। ভালো করে নদী শাসন করলি আমরা থাকপের পারতাম। এহন যে অবস্থা আমাদের জীবনই বাঁচে না।”
৭ নম্বর ফেরিঘাটের পশ্চিম পাশে এসে কথা হয় সালাম কাজীর সঙ্গে। তিনি বলেন, “আমরা তো রাতে ঘুমাতে পারি না। রাত হলেই ছেলে-মেয়ে নিয়ে নদীর পাড়ে বসে থাকি। এই নদী শাসন কবে হবে? বস্তা না ফেললে বাড়িতে থাকতে পারবো না। এভাবে কয়দিন রাত জাগা যায়? আমরা কি এদেশের জনগণ না? আমাদের কোনো জায়গা-জমি নাই, বাড়িঘর ভেঙে গেলে যাওয়ার জায়গা নাই।”
ওই এলাকার মো. বাহাদুর খান বলেন, “আমাদের এখানে সাতটা ফেরিঘাটের মধ্যে এখন চারটা আছে। তিনটা ফেরিঘাট নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন চারটা ঘাটের মধ্যে তিনটা ফেরিঘাট সারা বছর ভালো থাকে। বাকি একটা শুধু বর্ষা মৌসুমে ফেরি ভিড়ে। যদি ভালো থাকা ফেরিঘাটগুলো ভেঙে যায় তাহলে যাতায়াত ব্যাহত হবে।”
একই এলাকার কাদের মোল্লা বলেন, “রাতে তো ঘুম হয় না। নদী ঘরের কাছে। আমার ঘরের আগে একটা বাড়ি আছে সেটা গেলেই আমার বাড়ি নদীতে চলে যাবে। এজন্য রাতে মাঝে মধ্যেই দেখি ভাঙছে কি-না। অনেকের কয়েকটি গাছ ও রান্নাঘর নদীতে চলে গেছে। আমাদের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নাই। এবার বাড়ি ভেঙে গেলে পথে গিয়ে থাকতে হবে।”
দৌলতদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান মণ্ডল বলেন, “বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের কবর, বাড়িঘর, গাছপালা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এসব ছোট থেকেই দেখে আসছি অথচ আজ পর্যন্ত এর কোনো প্রতিকার হলো না।
“অস্থায়ীভাবে এখানে কিছু বস্তা ফেলানো হয় তবে সেটা বর্ষা মৌসুমে। শুষ্ক মৌসুমে যদি বস্তাগুলো ফেলানো হত তাহলে বর্ষার সময় ভাঙন দেখা দেয় না। আমাদের যারা নেতা আছে তাদের অনেকবার বলার পর তারা খুব কষ্টে এই বস্তাগুলো নিয়ে আসে।”
তিনি বলেন, “আবার যখন নদীতে ফেলে তখনও যেখানে ফেলার দরকার সেখানে না ফেলে অন্য জায়গায় ফেলায়। তারা বস্তা ফেলে ফেরিঘাট রক্ষার জন্য। তাদের লক্ষ্য থাকে ঘাট রক্ষা করা। ঘাটের পাশে যে শত শত পরিবার আছে তাদের কথা চিন্তা করে না।
“এখানকার বাসিন্দাদের বর্ষার সময় চোখে ঘুম থাকে না। রাত জেগে নদীর পাড়ে পায়চারি করে এই ভেবে কখন যেন তাদের বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।”
চেয়ারম্যান বলেন, “আমাদের দাবি, দুই-একদিনের মধ্যে এখানে বস্তা না ফেললে সাধারণ মানুষ কিন্তু আন্দোলনে চলে যাবে। এই ঘাট এলাকায় সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ বাড়ি ভাঙন ঝুঁকিতে আছে।”
বিআইডব্লিউটিএর টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট নাছিম হোসেন বলেন, “গত কয়েক দিনের ভাঙনে ৭ নম্বর ফেরিঘাটের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন রোধে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। দুই পাশ মিলিয়ে ২০০ মিটারের বেশি ভেঙে গেছে।”
তিনি বলেন, “এ ছাড়া ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে দৌলতদিয়ার ৩, ৪, ৬ ও ৭ নম্বর ফেরিঘাটসহ আশপাশের বসতবাড়িগুলোও।”
শুক্রবার ভাঙন এলাকা পরিদর্শনে এসে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা বলেন, “ঘাট যেখানে হুমকির মুখে পড়বে আমরা সেখানেই কাজ করব। এখানে সরকারের বড় পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি।
“আগে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। আর এখন যেভাবে ঘাট ভাঙছে তাতে আবারও সমীক্ষার প্রয়োজন হয়েছিল। যে কারণে প্রকল্পের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। খুব শিগগির আমরা একটা সিদ্ধান্তে এসে এখানে কাজ শুরু করব।”
আপাতত জিও ব্যাগ ফেলেই ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হবে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান।