হাওর ডেস্ক::
ভারত ও চীনের মধ্যে বিরোধের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশকে নিজস্ব পথে তিস্তা নদীর পানি সমস্যার সমাধান করার উপর জোর দিয়েছেন সাবেক রাষ্ট্রদূত আহমেদ তারিক করিম। এ নদীকে ঘিরে চলা আলোচনাকে উভয় দেশের ভালো বন্ধু হওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগানোর কথাও বলেছেন তিনি।
রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ইনসাইড আউটে নদী নিয়ে ভারতের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিরোধের কথা তুলে ধরে নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের সাবেক এই হাই কমিশনার বলেন, “আমরা জানি না, ভারত কীভাবে এই বিরোধ মেটাবে।
“এর মধ্যেই আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে এবং পানির সমস্যা আমাদের নিজেদের পথে সমাধান করতে হবে। কেননা, এ নিয়ে ভারতীয়দের অনুধাবন না হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারব না।”
যুক্তরাষ্ট্রে ও ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং সাউথ আফ্রিকায় হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা তারিক করিম বর্তমানে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের সেন্টার ফর বে অব বেঙ্গল স্টাডিজের পরিচালক।
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন ও ভারতের যুক্ত হওয়ার প্রস্তাবের বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের নিজস্ব নদী শাসনে যদি চীন অর্থ ও প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতা করতে আসতে চায়, আমি মনে করি আমাদের এটা নেওয়া উচিত। কেননা, ভারতের যদি টাকা না থাকে, তারা যদি সময় নেয়, আমাদের তো সময় নাই। আমরা সময়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি।
“এটা কাউকে রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য সাধনের উপায় দেবে কি না জানি না, তবে আমার মনে হয়, উভয়পক্ষকে আমাদের বোঝানো উচিত-এটা আমাদেরকে উভয় দেশের ভালো বন্ধু হওয়ার মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।”
তিস্তাকে বাংলাদেশের জন্য ‘খুবই গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে তুলে ধরে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, “তিস্তা অববাহিকায় তিন কোটি মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে এ নদী। নদীর অববাহিকা, যেটা সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে এসেছে সেখানে ৭০ শতাংশ মানুষ বাংলাদেশের। সুতরাং আমাদের স্বার্থ বিশাল।”
ইনসাইড আউটের আলোচনায় ১৯৪৫ সালের পর ’ওয়েস্টফালিয়ান’ ধারণার উপর ভিত্তি করে নদীর উপর কঠিন ও অভেদ্য সীমানা এঁকে দেওয়ার মাধ্যমে উপমহাদেশে নদী নিয়ে বিরোধের সূচনা হওয়ার কথা তুলে ধরেন তিনি। বলেন, “ওয়েস্টফালিয়ান সিনড্রোম, যেখান থেকে পার্টিশান সিনড্রোম এসেছে, যাতে নদীর উপরে কঠিন ও অভেদ্য সীমানা এঁকে দেওয়া হয়েছে। অথচ নদী কারও নয়। আমরা নদীর উপর নির্ভর করি।”
নদীর ব্যবস্থাপনা সার্বিকভাবে করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আমি ১৯৯৮ সালে চীন থেকে শিখেছি। যখন আমি একটা সাধারণ প্রশ্ন করেছি, ‘তোমরা কীভাবে নদী শাসন কর এবং সেটাকে নিয়ন্ত্রণ কর?’
“তারা বলল, ‘তুমি নদীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পার না, এটা প্রকৃতির শক্তি। প্রত্যেক নদীর নিজস্ব ব্যক্তিত্ব রয়েছে। শত শত বছর অর্থ, সময় ও শক্তি খরচ করে আমরা জেনেছি, তুমি কেবল নদীকে শাসন করতে পার, তবে সেটা কেবল পানিকে নিচের দিকে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে’।”
ভারত ও চীনের মধ্যে বিরোধের মধ্যেও উভয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ভারসাম্য রক্ষা করে চলার বিষয়ে এক প্রশ্নে তারিক করিম বলেন, “আমরা ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় কীভাবে আসব, সেজন্য আমাদের নিজস্ব প্রচেষ্টা চালাতে হয়। আমি মনে করি, ইচ্ছাটা সেখানে আছে। আমরা সেই ইচ্ছাটাকে কীভাবে কাজে পরিণত করব, সেখানে প্রশ্ন ও সন্দেহ আছে। তবে, আমরা এগিয়ে যাব।
“আমি মনে করি, গত ১৫ বছরে আমরা এটা হতে দেখেছি। আমরা একে অপরের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করতে পেরেছি। ভারত এবং চীন উভয়ের সঙ্গে।”
তিনি বলেন, “আমরা বলছি, আমরা ভারসাম্য রক্ষা করছি না। আমরা তোমাদের উভয়ের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক চাই। শুধু আমার ড্রয়িং রুমে এসে তোমরা যুদ্ধ কোরো না। তোমরা যুদ্ধ যা করার বাইরে কর।”
চীনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে, সেগুলোর মানদণ্ড (প্যারামিটার) ভারত সফরে ঠিক হয়ে গেছে বলেও মন্তব্য করেন তারিক করিম।
দুই দেশের বিরোধের মধ্যে বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নিতে পারবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কিন্তু উভয়ের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। আমি মনে করি, আমরা এটা পুরোপুরি স্পষ্ট করেছি।”
স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধুর ভারসাম্যপূর্ণ নীতি নেওয়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “চীন যখন পাকিস্তানের সঙ্গে মিলে আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছে, তখনও তিনি বিশেষ দূত পাঠিয়েছেন চীনে। কেন?
“তিনি ভবিষ্যৎ দেখেছেন যে, চীন এগিয়ে যাচ্ছে। এটা ক্ষমতার প্রধান জায়গা হবে। আমার মনে হয়, তিনি ধারণা করতে পেরেছিলেন ওই শতাব্দী বা পরবর্তী শতাব্দীতে এশিয়ার উত্থান হবে। যেটা এখন ঘটছে।”
চীন-ভারতের ক্রমবর্ধমান শক্তি হওয়ার কথা তুলে ধরে তারিক করিম বলেন, “কিছু ক্ষেত্রে এক দেশ আরেক দেশের চেয়ে এগিয়ে। আবার অন্য অনেক ক্ষেত্রে আরেক দেশ অন্য দেশের চেয়ে এগিয়ে। উভয়ে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।
“এই শতকে সবচেয়ে বড় বিশ্ব অর্থনীতি হওয়ার পথে রয়েছে এবং একমাত্র পরাশক্তির চ্যালেঞ্জার হওয়ার প্রক্রিয়াতেও আছে। এমন এক বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের বাস করতে হবে।”
তিনি বলেন, “ভারতও বর্ধমান শক্তি, সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র। কিছু অসামঞ্জস্য ও খুঁতের মধ্যে তাদের গণতন্ত্র যে এখনও কার্যকর, তা সাম্প্রতিক নির্বাচনে দেখা গেছে।
“দুই চাকা একটা পর্যায়ে এসে সমন্বয়ে আসবে। যদি এশিয়ার শতাব্দী হয়, তাহলে এশিয়ার সবচেয়ে বড় দুই শক্তি সরাসরি সংঘাতে জড়ালে এশিয়ার শতাব্দী হবে না। কেননা, এ প্রক্রিয়ায় তারা একে অপরকে ধ্বংস করবে এবং এশীয় শতাব্দী হওয়ার যে কোনো সুযোগকেও তারা ধ্বংস করবে। আমি মনে করি, ভালো বোধ বজায় থাকবে।”
তিনি বলেন, “এক দেশে সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্ক একক রেখায় চলে না। এটা জিগজ্যাগে চলে, ওঠানামা হয়-এভাবে সম্পর্ক চলে। কেন? কেননা, প্রত্যেক দেশ তার নিজস্ব স্বার্থ চিন্তা, প্রসার এবং রক্ষাকে প্রথমে দৃষ্টি দেয়। এভাবে যদি না করে তাহলে সেটা নিজেকে সার্বভৌম বলতে পারবে না।
“চলতি পথে এটা আপস এবং পথ পাল্টানো প্রভৃতির মাধ্যমে করে থাকে। কারণ, এটাকে হয়ত সরাসরি বিরোধে থাকা অন্য দেশের জাতীয় স্বার্থের বিষয়াবলিকে হিসাব করতে হয়। আপনি কীভাবে অন্যপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন, সেটা হচ্ছে আমাদের জাতীয় স্বার্থ একে অপরের সঙ্গে বিরোধের নয়, বরং পরিপূরক। যখন আপস করে একটা পর্যায়ে আসে, তখন আমরা সেটাকে দুদেশের সম্পর্ক বলে থাকি।”
উপনিবেশিকতা গেছে, সন্দেহ যায়নি
উপনিবেশিক আমলের সন্দেহের বাতাবরণ এখনও থেকে যাওয়ার কারণে ন্যাশনাল ব্যুরো অব এশিয়ান রিসার্চের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য তারিক করিম বলেন, “কেবল কে বেশি পাচ্ছে, কে কম পাচ্ছে তা নয়। এটা যৌথ উদ্যোগ। যেটা আমাদেরকে পিছিয়ে রাখছে সেটা হলো ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের মানসিকতাও বিভক্ত হয়ে গেছে।
“কাঁটাতারের বেড়ার বাইরে থেকে আমরা একে অপরের দিকে তাকাই। এবং যতদিন পর্যন্ত সেটা আমাদের মানসিকতাকে ধরে রাখবে, ততদিনে আমরা অগ্রগতি অর্জন করতে পারব না।”
যোগাযোগের প্রসঙ্গে গিয়ে তিনি বলেন, “১৯৪৫ সালের পর আমরা যে সীমানা পেয়েছি, সেই সীমানা আমাদেরকে বিভক্ত করে রাখছে।
“এটা আমাদেরকে এমন জোরালোভাবে বিভক্ত করে রাখছে যে, যেটা একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতার কোনো বোধই তৈরি করতে দেয়নি। অবশ্য যা পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আমি মনে করি, এটা বর্তমান সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণে বড় আকারে ঘটছে।”
যোগাযোগ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কাজ করার প্রসঙ্গ টেনে সাবেক এই কূটনীতিক বলেন, “আমরা ভারতকে বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, ভৌগোলিক ও নৌপথকে সার্বিকভাবে দেখতে হবে। এটাকে কেবল একার সার্বভৌম সম্পত্তি হিসেবে চিন্তা করলে হবে না; সাধারণের সার্বজনীন ঐতিহ্যের সার্বজনীন ব্যবস্থায় আমাদের পানি, আবহাওয়া, জীববৈচিত্র্যকে আপনি সীমান্ত দিয়ে আলাদা করতে পারবেন না।”
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “এটা একটা সূচনা, তবে সামনে কঠিন সংগ্রাম রয়েছে। প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে, এটা বড় হাতির মত-এটিকে এক পা সামনে এগিয়ে দেওয়ার আগে আপনাকে অনেকবার খোঁচাতে হবে। তার শরীরের ভারসাম্যহীনতা আরেক পা ফেলার জন্য বাধ্য করার জন্য আপনাকে খোঁচানো অব্যাহত রাখতে হবে। যখন এটা চলা শুরু করবে, তখন আপনি তাকে আর থামাতে পারবেন না।
“আমরা এখনও এক পা আরেক পা-কে অনুসরণ করানোর প্রচেষ্টায় আছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, এটা হবে। তবে তার জন্য বেশ অধ্যবসায় ও ধৈর্যে্যর প্রয়োজন রয়েছে।”
জাতিগুলো নিজেদের উন্নতিকে দেনাপাওনার সুখকর ভারসাম্যের অবস্থা বিবেচনা করে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যা প্রতিটি পক্ষকে বিশ্বাসের বিভ্রম দেয় যে, তার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হয়েছে।”
এ অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন না হওয়ার পেছনেও উপনিবেশিক আমলের সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যোগাযোগ তৈরি না করে আমরা প্রতিবেশীদের মধ্যে সন্দেহের কাল, পারস্পরিক সন্দেহ ও বিরোধ তৈরি করেছি।
“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যা নন-ওয়েস্টফালিয়ান অবস্থান থেকে উপবেশিক পরবর্তী সময়ের নতুন ওয়েস্টফালিয়ান ধারার উত্তরাধিকার। সেই ব্যবস্থাটা ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্র শক্তিরা করেছে।”
তারিক করিম বলেন, “পরাশক্তির নির্দেশনায় নতুন বিশ্বব্যবস্থার উৎপত্তি হয়েছে, যারা এখন বড় উপনিবেশিক শক্তি হতে পারত। যেখানে আপনার সীমানা আছে বটে, তবে আপনি সীমান্তের বাইরে বা ভেতরে ‘বিভক্তি ও শাসন’ করতে পারেন। যেটা আমার মনে হয় এখনও কাজ করছে।”
সম্পদ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্রিটিশ ভারতের তিন প্রেসিডেন্সির মধ্যে বাংলা সবচেয়ে ধনী থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “নৌপথের ধমনীর সংযোগ আমাদের সবাইকে যুক্ত করেছে।
“ব্রিটিশরা তাদের অধীন এলাকা থেকে সম্পদ তুলে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য এবং পণ্য এনে বিক্রির জন্য এই পথ ব্যবহার করেছে। এটা ছিল উপনিবেশিক তত্ত্ব ও চর্চার কেন্দ্রে ছিল।”
তিনি বলেন, “কানেক্টিভিটি পুনরুদ্ধারের গুরুত্ব আমাদের প্রধানমন্ত্রী বোঝেন। এই কানেক্টিভিটি কেবল ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে নয়, বরং এই অঞ্চলের মধ্যে।”
বড় পরিসরে কানেক্টিভিটির আলোচনা পঞ্চাশের দশক থেকে চলার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, জাতিসংঘের এসক্যাপ ‘ট্রান্সএশিয়ান রেল অ্যান্ড রোড কানেক্টিভিটি’ নিয়ে কাজ করেছিল।
“এটার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম এশিয়ার পুরো অঞ্চলের মানুষকে যুক্ত করার এবং বাণিজ্যের এমন ব্যবস্থা চালুর করার, যেটা ১৯৪৫ সাল পরবর্তী সময়ে ওয়েস্টফালিয়ান সীমানা ধারণার আগে বহাল ছিল।”
তিনি বলেন, “সুতরাং আমাদের কানেক্টিভিটি হচ্ছে বড় পরিসরের প্রকল্পেরই অংশ। আমরা পশ্চিমে এবং পূর্বে তাকাচ্ছি। পশ্চিমে কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে, পূর্বে এখনও অচিহ্নিত এলাকা রয়েছে।
“আমরা এখনও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পশ্চিমের দিকে তাকাতে অভ্যস্ত এবং আমরা এখনও পূর্বের বিশাল এলাকায় যে বিপুল সম্ভাবনা আছে, সেটা অনুসন্ধান করিনি।”
প্রসঙ্গ ভারতের সঙ্গে রেল কানেক্টিভিটি
ভারতের সঙ্গে আঞ্চলিক রেল যোগাযোগে নতুন এমওইউ সই করার বিষয়ে এক প্রশ্নে তারিক করিম বলেন, “এটা নির্ভর করছে বাংলাদেশ করিডর কীভাবে ব্যবহার করে তার উপর। প্রত্যেক দেশকে শুরুতে বুঝতে হবে, আমাদের বৈদেশিক সম্পর্ক বা নীতি হচ্ছে আমাদের জাতীয় স্বার্থের কার্যক্রম। আমি সবসময় বলে থাকি, জাতিগুলোর মধ্যে কখনই বন্ধুত্ব বলতে কিছু নেই।
“এটা হচ্ছে জাতিগুলো কীভাবে একে অন্যের সাথে একে অপরের সঙ্গে তুলনামূলক শক্তি ও সামর্থের বিবেচনায় দেনদরবার করে এবং অন্য দেশের জাতীয় স্বার্থ কীভাবে আপনার সামনে এসে ’সুখকর ভারসাম্যে’ মিলিত হয়। যদি সেই ভারসাম্য না থাকে, তাহলে আপনি সম্পর্কের সাবলীল কার্যক্রম দেখবেন না। একপক্ষ ভাববে অন্যপক্ষ বুঝি প্রতারণা করছে।”
তিনি বলেন, বিভাগ-পূর্ব সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে যে রেলযোগাযোগ ছিল, যেটা ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে বন্ধ হয়ে যায় তা শুরু করার বিষয়ে এমওইউ সই হয়েছে।
“সবচেয়ে কম দামী ও সর্বনিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী পরিবহন ব্যবস্থা হচ্ছে নৌপথ। কম তেল খরচ আর কম কার্বন নিঃসরণ করে বেশি পণ্য আনা নেওয়া করে। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, রেলপথ। যেটা সড়কপথের যোগাযোগের চেয়ে তিনগুণ বেশি কার্যকর। সবচেয়ে খরুচে ও বেশি কার্বন নিঃসরণকারী ব্যবস্থা হচ্ছে সড়কপথ।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির পর দীর্ঘদিনের বিরোধপূর্ণ দেশ জার্মানি ও ফ্রান্সের নতুনভাবে সম্পর্ক তৈরির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ইংল্যান্ড ও পুরো ইউরোপে শিল্প বিপ্লব শুরু হলেও তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, একে অপরের সঙ্গে তাদের বিরোধের কারণে।
এরপর ওয়েস্টফালিয়ার ধারণাকে নতুনভাবে বিবেচনা করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, তারা সার্বভৌমত্বের ধারণাকে নতুনভাবে বিবেচনা করে একের ভূখণ্ডে অন্যকে সহযোগিতার ধারণা নিয়ে কাজ করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ইউরোপ, আসিয়ান, আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের দেশগুলোর জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করার কথা তুলে ধরে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, সেটা অনেক দিন না থাকলেও এখন সহযোগিতার নানা মাত্রা যুক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে এখনও জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছার মত রাজনৈতিক অবস্থান তৈরি না হওয়ার কথা তুলে ধরে তারিক করিম বলেন, “আমরা যুদ্ধ করে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছি, কিন্তু এখন আমরা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি।
“আমরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করছি, আমরা রাজনৈতিকভাবে খুব বিভক্ত, অনেক ইস্যুতে আমরা ঐকমত্যে আসতে পারিনি। ফলে এক দল যা-ই করে, আরেক দল থেকে তার বিরোধিতা আসে।”
তিনি বলেন, “এই বিষয়টা আমাদেরকে তুলে ধরতে হবে যে, আমাদের জাতীয় স্বার্থ কী, সে ব্যাপারে ঐকমত্যে আসতে হবে। আমরা অগ্রগতির পথ কীভাবে অর্জন করতে পারি, কোথায় আমরা যাব, কোন কোন দেশের মার্কেটকে আমরা তুলে ধরব- এসবক্ষেত্রে দেনাপাওনার ব্যাপার আছে। আপনি আরেকপক্ষ থেকে কিছু নেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে দেওয়ার ব্যাপার আছে।”
তিনি বলেন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনো বিরোধে না গিয়ে আমাদের ঠিক করতে হবে যে, এই পূর্বাভাসকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের জন্য কী অর্জন করতে পারব। কাছের কিংবা দূরের বৈদেশিক যে ইস্যুগুলো আছে, সেগুলো আমাদেরকে দেখভাল করতে হবে।
আঞ্চলিক জোট বিমসটেক কর্তৃক কোস্টাল শিপিং যোগাযোগের বিষয়ে কাজ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যা শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত যোগাযোগ তৈরি করতে পারে।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব কোথায়?
অর্থনৈতিক অগ্রগতির পাশাপাশি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা তুলে ধরে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক’ হিসেবে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ধারণা কাজ করছে’।
“এ দুটো অনেকটা একই। তারা সমুদ্র পথে পূর্ব থেকে পশ্চিম বা পশ্চিম থেকে পূর্ব গোলার্ধে দিকে পরিবহনের চিন্তা করছে। আমরা হুট করে এর মাঝখানে নিজেদের পেয়েছি। যদি ইন্দো-প্যাসিফিকে দুই মহাসাগরকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছে, সেটাকে কে সংযুক্ত করেছে? বঙ্গোপসাগর।”
বঙ্গোপসাগরের ঠিক উপরে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ার কথা তুলে ধরে তারিক করিম বলেন, “হয়ত ছোট দেশ, আয়তনে ছোট; কিন্তু শক্তির দিক থেকে ছোট নয়। আমরা বর্ধমান শক্তি।
“প্রায় ১৮ কোটি মানুষ যেটাকে বাদ রাখার মত নয়। ৪ থেকে ৫ কোটি হচ্ছে যুবশক্তি, যা এখনও আছে; আগামী ২০-৩০ বছরে আমরা এটা হারানো পর্যন্ত। এ অঞ্চলের অন্যতম বর্ধনশীল অর্থনীতি। আমরা আমাদের সামর্থের প্রমাণ দিয়েছি।”
তিনি বলেন, “আমাদের হয়ত অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু যখনই আমরা পথ চলা শুরু করব, পথরেখা সামনে পাওয়া যাবে। আপনি যখন কোনো জাহাজ চালান, তখন সেটা সবসময় শান্ত আবহাওয়ায় চলে না, ঝড়ও থাকে। সেই ঝড়ের মধ্য দিয়ে জাহাজ চালিয়ে নেওয়াতেই থাকে বুদ্ধিমত্তা।
“আমি এক্ষেত্রে সরকারকে ধন্যবাদ দিব, তারা এটাকে স্থিতিশীল আউটলুকের দিকে রাখতে পেরেছে। আমরা ডানে কিংবা বামে হেলে যাচ্ছি না, সামনে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা চলতিপথে বাধা মোকাবেলা করে যাচ্ছি।”
তিনি বলেন, “এখানে সমস্যা থাকবে। আমরা সমস্যা অব্যাহতভাবে মোকাবেলা করতে থাকব। তবে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা চলতে থাকব, আমরা ফলাফল দেখতে পাব।”
আরও পড়ুন-
তিস্তা প্রকল্প ভারত করলে সব সমস্যারই সমাধান হয়: প্রধানমন্ত্রী
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীনের পর এবার ভারতের প্রস্তাব
গঙ্গা-তিস্তার আলোচনায় চটেছেন মমতা, মোদীকে চিঠি
তিস্তায় চীন-ভারতকে কীভাবে সামলাবে বাংলাদেশ
তিস্তা চুক্তি কেন হয়নি: প্রধানমন্ত্রীকে ফখরুল
তিস্তার জট খুলতে ভারতের সংসদীয় কমিটির সুপারিশ কোন বার্তা দিচ্ছে?
প্রস্তাব পেলে তিস্তা প্রকল্পে সহযোগিতা দেবে চীন, বললেন রাষ্ট্রদূত