হাওর ডেস্ক::
ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারি বর্ষণের সঙ্গে সুনামগঞ্জেও টানা বৃষ্টি হওয়ায় নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। এতে দ্বিতীয়বার বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে সুনামগঞ্জে ।
এর মধ্যে সুনামগঞ্জের সুরমা, যাদুকাটা ও পুরাতন সুরমার পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসও বলছে আগামী আরো চারদিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকবে।
এই অবস্থায় নদ নদী ও হাওর আগের বন্যার পানিতে পরিপূর্ণ থাকায় এখন পানি বাড়লে পরিস্থিতির অবনতি হবে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার জানান, মেঘালয়ে রোববার থেকে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। রোববার রাত থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত মেঘালয়ে ৩১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। মেঘালয়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হলেই সুনামগঞ্জে বন্যার শঙ্কা দেখা দেয়।
এই পানি মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি থেকে সুনামগঞ্জ আসতে ছয়-আট ঘণ্টা সময় লাগে। মূলত উজানের ভারি বর্ষণ পাহাড়ি ঢলের সৃষ্টি করে। আর এতেই বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় সুনামগঞ্জে।
মামুন হাওলাদার আরও জানান, একই সময়ে সুনামগঞ্জেও প্রায় ১৭০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। ছাতক পয়েন্টে হয়েছে ৫১ মিলিমিটার এবং তাহিরপুরের রাউড়েরগড় পয়েন্টে হয়েছে ২৩৭ মিলিমিটার।
তিনি জানান, এই বৃষ্টিপাতের ফলে সুনামগঞ্জে রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত সুরমা নদীতে পানি বেড়েছে ৬৩ সেন্টিমিটার। তবে রাত ৯টায় বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। একই সময় এই নদীতে ছাতক পয়েন্টে পানি বেড়েছে ৫১ সেন্টিমিটার। যা বিপদসীমার ৩২ সেন্টিমিটার উপরে।
এছাড়াও যাদুকাটা নদীতে রোববার সন্ধ্যা থেকে সোমবার বিকাল পর্যন্ত পানি বেড়েছে ১৭৪ সেন্টিমিটার। রাত ৯টায় যাদুকাটা নদীতে বিপৎসীমার ৯৬ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে।
আগামী ৪-৫দিন এমন ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস আছে বলেও জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের এই প্রকৌশলী।
এদিকে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ওয়েজখালী এলাকার বাসিন্দা কিতাব আলী বলেন, “আমি ঈদের দিন থেকে পরিবার নিয়ে এক সপ্তাহ আশ্রয় কেন্দ্রে ছিলাম। চার-পাঁচ দিন আগে বাড়িতে এসেছি।
“এসে দেখি হাওরের ঢেউয়ে বাড়ির ভিটা ধসে গেছে। বেড়া ও টিন নিচে পড়ে গেছে। কষ্ট করে সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে সংস্কার করে এখন আবারও বন্যার মুখে। গরিব মানুষ বারবার এই ক্ষতি পোষাবো কীভাবে?”
দিরাই উপজেলার পেরুয়া গ্রামের কৃষক নেতা অমর চান দাস বলেন, “সুনামগঞ্জের হাওরে এখন বড়ো বর্ষা চলছে। এটা হাওরের স্বাভাবিক চিত্র। তবে বিপর্যয় হচ্ছে সুরমা নদী তীরবর্তী জনপদ বিশেষ করে সীমান্ত উপজেলাগুলোর। মেঘালয়ের ঢলে পানি দ্রুত নেমে এখানে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।
“এছাড়াও পাণ্ডারখালে বাধ থাকার কারণে এখন মেঘালয়ের পাহাড়ি ঢলের সব পানি সুরমা নদীকেই বহন করতে হয়। আগে এই নদীর পানি পাণ্ডারখাল ও মহাসিং হয়ে কুশিয়ারা-মেঘনায় চলে আসতো। এই পথ বন্ধ থাকায় এবং নদ নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, এর সঙ্গে হাওরের অপরিকল্পিত বাঁধও দায়ী। যত্রতত্র বাঁধ দেওয়ায় সুরমা নদীর পানি দক্ষিণ-পূর্বে আসতে বাধা পাচ্ছে। যে কারণে সুরমা নদী তীরবর্তী এলাকায় সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পর্যন্ত এই সময়ে বিপর্যয় দেখা দেয়।
“এখন পানি বাড়লে হাওরের উপরও চাপ পড়বে। তাই হাওর এলাকায়ও বন্যা দেখা দিবে।”
হাওর আন্দোলনের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, “সুনামগঞ্জ এবার দ্বিতীয় বন্যার মুখে। আগের বন্যার পানি এখনও রয়ে গেছে। এখন পাহাড়ি ঢলে দ্বিতীয় বন্যার সৃষ্টি হবে। এতে দুর্ভোগ বাড়বে।
“নদী খনন করা এবং অপরিকল্পিত বাঁধ তৈরি করা ও যাচাই বাছাই না করে চলাচলের রাস্তা তৈরি করা থেকে বিরত থাকতে হবে”, বলেন তিনি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, “নদ-নদীর পানি বাড়ায় ফের বন্যার আশঙ্কা আছে। তাই আমরা আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেছি। পাশাপাশি বন্যা মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে।
তিনি বলেন, “কিছুদিন আগেও জেলার প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষ বন্যা কবলিত হয়েছিলেন। ৭০২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছিল। এরমধ্যে ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ২৬ হাজার বন্যা কবলিত লোকজন অবস্থান নিয়েছিলেন। এবারও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে প্রশাসন মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত আছে।”