হাওর ডেস্ক::
পার্বত্য জেলা রাঙামাটিতে ২০১৭ সালে ভয়াবহ পাহাড় ধসে প্রাণ হারান ১২০ জন। এরপর ধস রোধে নানান পরিকল্পনার কথা শোনা গেলেও দৃশ্যত কোনো উন্নতি হয়নি। বরং পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা আরও বেড়েছে বলেই জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বছরজুড়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবৈধ বসতিতে পানির সংযোগ, পৌর কর গ্রহণ, বিদ্যুৎ সরবরাহের মত নাগরিক সুবিধা প্রদান করা হলেও বর্ষা এলেই কিছুটা নড়েচড়ে বসে স্থানীয় প্রশাসন।
টানা বৃষ্টি হলে শহরে মাইকিং, প্রচারপত্র বিতরণ আর আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রেখেই দায় সারেন তারা। তবে বাস্তবতা হল, এমন প্রচারে খুব একটা সাড়া দেন না ঝুঁকিতে বসবাসকারীরা।
তারা বলছেন, বৃষ্টি হলেই আশ্রয়কেন্দ্র যাওয়ার চাপ নয়; বরং পুর্নবাসনসহ স্থায়ী সমাধান চায় মানুষ।
আর নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, শুধু বর্ষাকালে সচেতনতার প্রচার না করে এইসব ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে যেন মানুষ বসতি গড়তে না পারে সেই বিষয়ে নজরদারি জরুরি।
এদিকে গত কয়েক দিনের মাঝারি ও ভারি টানা বর্ষণের কারণে আবারও তৈরি হয়েছে পাহাড় ধসের ঝুঁকি। আর বরাবরের মতই মাইকিং করে লোকজনকে সতর্ক থাকা ও নিরাপদে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখার তথ্যই জানাচ্ছে জেলা প্রশাসন।
বর্ষা এলেই আহাজারি করে সরে যাওয়ার এই নির্দেশনাকে ‘দ্বিচারিতা’ হিসেবে উল্লেখ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর রাঙামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক জিসান বখতেয়ার বলছেন, “সারা বছর ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে বর্ষা এলে মাইকিং করে সরে যাওয়া নির্দেশনা হাস্যকর। এসব ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের নিরাপদ ও স্থায়ী জায়গায় সরিয়ে নিতে হবে। নতুবা এভাবে বৃষ্টি এলেই আশ্রয়কেন্দ্র খুলে সমস্যার সমাধান হবে না।
“২০১৭ ও ২০১৮ সালের ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা যেসব পরামর্শ দিয়েছিলেন তার কোনো বাস্তবায়ন তো আমরা দেখিনি। বরং পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে।”
জিসান বখতেয়ার বলেন, “পাহাড়ে এতগুলো উন্নয়ন সংস্থা, কারো কাছেই হিসাব নেই, ঠিক কী সংখ্যক মানুষ পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে। এটা আশ্চর্যজনক ঘটনা। আমাদের ধারণা অন্তত হাজার বিশেক মানুষ ঝুঁকিতে বসবাস করছেন, যাদের রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ওমর ফারুক বলছেন, “এটা সাময়িক কোনো সমস্যা না, এটা আমাদের স্থায়ী সমস্যা। এটার সমাধানও হতে হবে স্থায়ী। এইভাবে বৃষ্টি এলেই আশ্রয়কেন্দ্র খুলে ঠাঁই দেওয়াটাই তো সমাধান নয়।
“এসব দরিদ্র মানুষ তো এমন জায়গায় বসবাস করতেই চাইবে, এটাকে কীভাবে সমাধান করা যায়- সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। সরকার অতিদরিদ্র মানুষের স্থায়ী বসবাসের জন্য নানা উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। রাঙামাটি শহরে এমন মানুষ খুব বেশি হবে না। তাদের জন্য স্থায়ী সমাধান খুঁজতে হবে।”
রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী বলছেন, “এটা রূঢ় কঠিন একটি বাস্তবতা। এভাবে বৃষ্টি এলেই মাইকিং আর সরিয়ে নেওয়ার কাজটি দীর্ঘসময় ধরে চলতে পারে না। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে তাদের সরিয়ে স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
“প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আছে, সেসব কর্মসূচির মাধ্যমেও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে নিয়ে স্থায়ী পুনর্বাসন সম্ভব।”
স্থায়ী সমাধান চান ঝুঁকিতে বসবাসকারীরাও
শহরের রূপনগর, শিমুলতলী ও নতুন পাড়া এলাকার সমাজ কমিটির প্রধান আবু বক্কর লিটন মিঠু বলেন, “আমাদের এলাকার জন্য বি এম কলেজ ও রাঙামাটি বেতার আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে যাওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই।
“কারণ বৃষ্টি হলেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলে, পরে তেমন কিছুই হয় না। তাই লোকজন আগ্রহী হয় না যেতে। তবে পরিস্থিতি খারাপ হলে অবশ্যই সবাইকে নিয়ে যাব।”
তবে এইভাবে বারবার আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়টি ‘কঠিন’ মন্তব্য করে মিঠু বলেন, “পাহাড়ের পাদদেশে পৃথিবীর যেখানেই বসবাস করে সেটাই তো ঝুঁকিপূর্ণ। এর জন্য পাহাড়ের ঢালে রিটার্নিং ওয়াল নির্মাণ, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারীদের স্থায়ী জায়গায় সরিয়ে নেওয়া, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, সড়কের পাশে ধারক দেয়ালসহ এর স্থায়ী সমাধান দরকার।
“না হলে লোকজন ঝুঁকিতেই বসবাস করতে থাকবে এবং ঝুঁকিও থেকে যাবে। কারণ এখানে যারা বসবাস করে তাদের বড় অংশই দরিদ্র মানুষ, নিজের শেষ পুঁজিটি দিয়েই জায়গা কিনে বসত গড়েছেন, তার তো যাওয়ার বিকল্প কোনো জায়গা নেই।”
শিমুলতলী এলাকায় বসবাস করা শ্রমিক হাবিবুর রহমান বলেন, “অনেক কষ্টে কিছু টাকা জোগাড় করে বসতঘরের এই জায়গাটির দখল কিনেছি। জানি যে, এখানে বসবাস করা ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু কী করব? এ ছাড়া তো আর কোনো ঠিকানা নেই।
“এখন সামান্য বৃষ্টি হলেই প্রশাসন চাপাচাপি করে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে। এভাবে প্রতিদিনই যাওয়া-আসা করতে করতে মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটার তো একটা স্থায়ী সমাধান করা উচিত।”
মো. খলিল, যিনি পরিবার নিয়ে রেডিও স্টেশন এলাকায় বসবাস করেন, বলছিলেন, “বৃষ্টি হলেই আশ্রয়কেন্দ্রে দৌঁড়াতে হয়। সেখানে পানি থাকে না, বিদ্যুৎ থাকে না, আলো নাই, পর্যাপ্ত বাথরুমও নাই। থাকার ব্যবস্থা তো নাই-ই।
“প্রতিদিন বৃষ্টি হবে আর প্রতিদিনই আশ্রয়কেন্দ্রে দৌঁড়াতে হবে, এটা কেমন জীবন? সরকারের তো অনেক উদ্যোগের কথা শুনি, আমাদের বেলায় কেন নেই এসব?”
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলছেন, “বিষয়টি আমারও ভাবনার মধ্যেই আছে। আমিও কাজ করছি। এর মধ্যেই সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছি ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের তালিকা করতে।
“তালিকা হাতে পাওয়ার পর তাদের সংখ্যা দেখে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেব আমরা। আমরাই একটি স্থায়ী সমাধানই করতে চাই।’
টানা বৃষ্টিতে আবার ঝুঁকি, আবার ‘সচেতনতার’ প্রচার
এদিকে রাঙামাটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের তথ্যমতে, রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার ৯টা সকাল থেকে মঙ্গলবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ১০৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। টানা বৃষ্টির কারণে বেড়েছে পাহাড় ধসের ঝুঁকি।
ফলে পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকি নিয়ে বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে জেলা প্রশাসন থেকে মাইকিং করা হচ্ছে। রাঙামাটি শহরের ২৩টিসহ জেলায় মোট ২৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে জানান হয়েছে।
রোববার ও সোমবার জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুবাইয়া বিনতে কাশেম এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শিব শংকর বসাকের নেতৃত্বে জেলা প্রশাসনের একটি বিশেষ টিমকে শহরের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সচেতনতামূলক প্রচার চালাতে দেখা গেছে।
এ সময় তারা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভারী বর্ষণ শুরু হলে নিরাপদ আশ্রয় অথবা নিকটবর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলছেন বসবাসকারীদের।
তবে মাইকিং ও সচেতন করার চেষ্টা করা হলেও স্থানীয়রা সোমবার বিকাল পর্যন্ত কোনো আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেননি।
রাঙামাটি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রিফাত আসমা জানান, তালিকা অনুযায়ী পৌর এলাকায় এক হাজার ৩৬৪টি পরিবার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করছে। তাদের জন্য পৌর এলাকায় ২৩টি, ছয়টি ইউনিয়নে ৫৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এর আগে ২০১৭ সালে রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে ১২০ জন এবং ২০১৮ সালে ১১ জনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই প্রতি বর্ষায় টানা বর্ষণ হলেই পাহাড়ের ঢালে বসবাসকারীদের সরিয়ে নেওয়া হয়।