হাওর ডেস্ক::
ঢাকা সিটি করপোরেশনের অংশ হয়ে লাভটা কী হল, আট বছর পর সেই প্রশ্ন করতেই পারে ঢাকার উত্তরা লাগোয়া জনপদ দক্ষিণখানের বাসিন্দারা।
এলাকাবাসী আগে ইউনিয়ন পরিষদে ভোট দিত, এখন দেয় সিটি করপোরেশনে- এই বিষয়টি ছাড়া আট বছরে দক্ষিণখানবাসীর দৃশ্যমান কোনো প্রাপ্তি আছে কি না, সেই ‘সমীকরণের খাতাটি’তে হিসাব মেলানো কঠিন।
বর্ষার প্রথম বৃষ্টির পর থেকেই এলাকার বেশিরভাগ সড়ক পানিতে ডুবে আছে। পানিতে ডুবেছে অনেক বাড়িঘর, দোকানপাট। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি থাকায় ব্যাহত হচ্ছে পাঠদান। চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা বলছেন, এটি প্রতি বছরের চিত্র।
নাগরিক সেবা বাড়াতে ২০১৬ সালের ২৮ জুন ১৮টি ইউনিয়নকে দুই সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। দক্ষিণখান, উত্তরখান, হরিরামপুর, বাড্ডা, সাঁতারকুল ও ভাটারা ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে গড়ে তোলা হয় নতুন ১৮টি ওয়ার্ড।
তবে সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত হলেও ওইসব এলাকায় নাগরিক সুবিধা এখনও বাড়েনি। স্থানীয় বাসিন্দারা জলাবদ্ধতা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে আছেন।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেছেন, তিনি নিজেও ভুক্তভোগী। তবে বেশ কিছু প্রকল্প চলছে। ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র বলছেন, ‘৫০ বছরের’ জঞ্জাল সরাতে সময় লাগবে।
এলাকায় দুর্ভোগের চিত্র
মঙ্গলবার দক্ষিণখানের দেওয়ানবাড়ী রোড, সংগ্রামী রোড, চালাবন রোড, গণ কবরস্থান রোড, মাটির মসজিদ রোড, কাজীবাড়ী রোডসহ কয়েকটি সড়কে গিয়ে দেখা গেছে সেগুলোর কোনটা পুরোপুরি,কোনটা আংশিক পানিতে তলিয়ে আছে।
ডিএনসিসির ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের মাটির মসজিদ এলাকার ৩৮৫ নম্বর বাড়িতে এবারের বর্ষায় প্রথম বৃষ্টির সময় পানি ওঠে, উঠানের সেই পানি আর সরেনি।
এখন বৃষ্টি হলে ঘরের মধ্যে পানি চলে যায়। পানি ঠেকাতে দরজায় ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাধাই করে নিয়েছেন বাসিন্দারা।
ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া জিয়াসমিন বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৪-৫ দিন আগের বৃষ্টিতে পানি জমেছে। এরপর পানি আর কমে না, খালি আসে। এক ঘণ্টা যদি ঠাসা বৃষ্টি হয় তাইলে ঘরে পানি চলে আসে, তখন সেচে কুল পাওয়া যায় না। যেই অবস্থা দেখা যাচ্ছে বাসা ছাইড়া দিতে হবে।”
চালাবন্দের বাসিন্দা আমিনা বেগম জানালেন, এলাকার এই অবস্থায় গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি।
“আমি এই এলাকায় ভাড়া থাকি অনেক বছর। কিন্তু আর থাকব না। এই ময়লা কাদা, পানির মধ্যে কেন থাকব? রাস্তাঘাট ভালো না।”
দক্ষিণখানের চালাবন্দ এলাকার শিশু কল্যাণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে কাজীবাড়ী সড়কে অন্তত কোমরসমান পানি জমে আছে। পানি এবং সড়কে গর্ত থাকায় ওই সড়কে ছোট যানবাহন, রিকশা চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। খুব প্রয়োজনে কিছু ট্রাক, কাভার্ডভ্যান চলাচল করতে দেখা গেছে। পানির কারণে সড়কের পাশের দোকানগুলো বন্ধ।
পানি উঠেছে শিশু কল্যাণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনের নিচতলায়। ফলে দোতলায় ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। কোমর সমান পানি থাকায় ওই বিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছানো যায়নি। ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা কয়েকজন।
ওই এলাকার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই সড়কের অবস্থা এমন যে শুকনো মৌসুমেও এখানে পানি জমে থাকে।
“রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ, এখন ভয়ে রিকশাওয়ালারা ওই সড়ক দিয়ে যায় না। বেশিরভাগ সময় পানি পাড়াইতে হয় তাই আমার মত অনেকেই গামবুট পায়ে দিয়ে হাঁটেন। ওই যে স্কুল দেখছেন পানি না মাড়িয়ে সেখানে যাওয়া যায় না, এজন্য ছোট বাচ্চারা স্কুলে আসে না। ক্লাস হয় দোতলায়।”
স্থানীয় বাসিন্দা লাইজুদ্দিন আহমেদ বলেন, ৫-৬ বছর আগে থেকে এলাকায় জলাবদ্ধতা বাড়তে থাকে। আগে এই এলাকার বিভিন্ন বাড়িঘরের ফাঁকে ফাঁকে খালি জায়গা ছিল। পানি সরতে পারত। কিন্তু এখন ফাঁকা জায়গা নেই, পানি সরার জায়গা নেই। তাই সংকট।
“একটা সড়কের নিচে দিয়ে একটা পাইপ ছিল। ওই পাইপটা ভেঙে গেছে, এছাড়া পাইপের মুখে বাড়ি হয়ে গেছে। ফলে পানি নামতে পারে না।”
জলাবদ্ধ হয়ে আছে দক্ষিণখানের গণ কবরস্থান সড়কটিও। পানিতে তলিয়ে থাকায় ওই সড়কেও ছোট যানবাহন চলাচল করে না। সড়কের পাশের ফুটপাতে বালুর বস্তা ফেলে উঁচু করা হয়েছে। সেখান দিয়ে হেঁটে চলাচল করেন পথচারীরা।
ওই সড়কের একটি বাড়ির বাসিন্দা জসিম উদ্দিন মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এই এলাকায় কোথাও এমন জায়গা নেই যেখানে পানি নাই। সড়কগুলো জলাবদ্ধ থাকায় নানা ধরনের সমস্যায় পড়েছেন তারা।
“বাজারে মাছ নাই, খাবার নাই। একটা রোগী নিলে কাঁধে করে ছাড়া উপায় নাই। বাড়িতে কোনো মেহমান আসলে পাঁচদিন আগে থেকে চিন্তা করতে হয় তাকে কীভাবে বাসায় আনব। এই রাস্তায় চলতে এমন কোনো দিন নাই যে একটা লোক আঘাত না পাইছে, অনেকের পা ভাঙছে। রাস্তা নিয়া যে কত্ত নিউজ হইছে ভাই, কিন্তু কোনো সমাধান হচ্ছে না।”
চৈতী গার্মেন্টস এলাকার দোকানদার মোজাম্মেল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা দিন দিন বাড়ছেই।
“যতই বৃষ্টি হচ্ছে সমস্যা ততই বাড়ছে। রাস্তার নোংরা পানি বাসাবাড়িতে চলে আসছে। পানির কারণে লোকজন বাসা থেকে খুব একটা বের হয় না। আমার একটা দোকান আছে, কাস্টমার নাই, সারাদিন বইসা মাছি মারি।”
পানি ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ঘরেও
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোতালেব মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার ওয়ার্ড এবং পাশের ওয়ার্ডসহ দক্ষিণখানের সব এলাকায়ই জলাবদ্ধতা মূল সমস্যা।
“চালাবন, মৌসাইর, ফায়দাবাদ কোন এলাকার কথা বাদ দিমু? সব এলাকায় জলাবদ্ধতা। আমার ঘরের ভেতর এখনও পানি। আমার ওয়ার্ডটা নীচু বেশি। ফলে আশপাশের পানি আমার ওয়ার্ডের এলাকা দিয়ে যায়।”
তিনি বলেন, ডিএনসিসি নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের রাস্তাঘাট-ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়নে যে প্রকল্প নিয়েছে তাতে কিছু কাজ হয়েছে, কিছু হচ্ছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এলাকার জলাবদ্ধতা কিছুটা কমবে।
“বড় রাস্তায় পাইপটা হয়ে গেছে, আরও দুইটা সড়কে পাইপ বসানো হচ্ছে। ফলে ছাপড়া মসজিদ, মুজিবুর মার্কেট ও ফায়দাবাদের পশ্চিমাংশ দিয়ে কিছুটা পানি যাচ্ছে। এছাড়া বাকি এলাকাগুলোর জন্য এমপি মহোদয় এবং মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলে চালাবনের ভেতর দিয়ে যদি একটা ড্রেন করতে পারি তাহলে ওই এলাকার জলাবদ্ধতা হয়ত কিছুটা কমবে।”
৫০ বছরের জঞ্জাল সরাতে সময় লাগবে: মেয়র
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নতুন ওয়ার্ড এলাকাগুলো অপরিকল্পিত ছিল এ কারণে নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না। ডিএনসিসি নতুন ওয়ার্ডের সড়ক ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নয়নে একটি প্রকল্প নিয়েছে। এর আওতায় কিছু এলাকায় কাজ শুরু হয়েছে। ধীরে ধীরে সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।
“এই এলাকায় রাস্তা নাই, ড্রেন নাই, থাকলেও ওপেন। আগে এত ঘরবাড়ি ছিল না বলে পানি জমত না। কিন্তু এখন ফাঁকা জায়গা নেই। পানি যাওয়ার জায়গাও নেই।
“আমরা পানি নিষ্কাশনের জন্য একটি প্রকল্পের আওতায় কাজ শুরু করেছি। প্রধান সড়কে ৬ ফুট ব্যাসের পাইপ বসানো হচ্ছে। এছাড়া পাঁচ ফুট ও চার ফুটের ড্রেন বসানো হবে। সমস্যা হচ্ছে এই এলাকায় রাস্তা নাই, আবার খুবই সরু। এছাড়া আমি কোয়ালিটি নিশ্চিত করে কাজ করছি, এজন্য দেরি হচ্ছে। আমি বুঝি ওই এলাকার মানুষের খুব ভোগান্তি হচ্ছে। কিন্তু ৫০ বছরের জঞ্জাল সরাতে কিছুটা সময় লাগবে। আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে মূল সড়কের কাজটি শেষ হবে। ধাপে ধাপে অন্য সড়কগুলোর উন্নয়নও হবে।”