হাওর ডেস্ক::
মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার রোকেয়া বেগমকে কোরবানির ঈদের দুদিন আগে রাসেলস ভাইপার সাপে কামড়েছিল। ওঝার কাছে গিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে দারস্থ হন হাসপাতালের। দুই হাসপাতাল ঘুরে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে দুই দফায় ১৫ দিন চিকিৎসা নিয়ে এখন অনেকটাই সুস্থ রোকেয়া। তবে নানা শারীরিক সমস্যা আছে তার।
রোকেয়ার ভাষ্য, একটু দেরিতে হলেও হাসপাতালে এসেছিলেন বলেই তিনি চিকিৎসকদের সেবায় বেঁচে গেছেন।
পাশাপাশি চিকিৎসকও সাপেকাটা রোগী ও স্বজনদের উদ্দেশে বলেছেন, যে সাপেই কামড়াক তাকে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
সাপেকাটা রোগীর প্রথম ১০০ মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওঝা বা কবিরাজের কাছে গিয়ে কোনো লাভ নেই। তাদের কাছে কোনো চিকিৎসা নেই। সাপেকাটা রোগীর সময়ক্ষেপণ করার মানে হচ্ছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা।
গত দু বছর ধরে পদ্মা অববাহিকা অঞ্চলে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রব বেড়েছে। এতে মানুষের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। চিকিৎসকদের ভাষায়, বর্ষাকালে এমনিতেই সাপের উপদ্রব বাড়ে; কিন্তু রাসেলস ভাইপারের ব্যাপক মাত্রায় উপস্থিতি এখন ‘আলোচিত ঘটনা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
উপজেলার ভেলাবাদ গ্রামের বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী রোকেয়া বেগম রাসেলস ভাইপার সাপের কামড় খান বাড়ির পাশে শাক তুলতে গিয়ে। তার বাম পায়ের কনিষ্ঠা আঙুলের উপরের স্থানে সাপে কামড় দেয়। তার বাড়ি থেকে পদ্মা নদীর দূরত্ব এক কিলোমিটারেরও কম।
সোমবার দুপুরে তিনি বাড়িতে বসেই বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় পরিবারের কয়েকজন সদস্যও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে রোকেয়া বেগম বলছিলেন, বিকালে বাড়ির পাশে তিনি শাক তুলতে যান। পাশেই ক্ষেতে তার দেবর কাজ করছিলেন। তার স্বামী ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন অন্য এলাকায়।
তিনি বলছিলেন, “অল্প কিছু শাক তুলে একটা পাত্রে রাখি। পরে আবার তুলতে পা বাড়াই। তখন বাম পায়ে কিছু একটা লাগে। আমি ভাবলাম বড়ই কাঁটা হয়ত। আবার ঘুরে আসি। সাপের উপর দিয়েই আসি। ঘুরে এসে পরে দেখি একটা মোটা সাপ, এই বড়। পাইটক্যাল কালারের ডোরা ডোরা ছোপ ছোপ ছাপাওয়ালা সাপ। পায়ে জ্বালা শুরু হয়ে গেছে। রক্তও বের হচ্ছে।
“আমি দেবররে ডেকে বললাম, ভাই, আমারে তো সাপে কামড়েছে। দেবর আমারে বলে, ভাবী তাড়াতাড়ি বাড়ি চলেন। বাড়ি আসার পরে ওই জায়গা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিছে।”
পরে পাশের এলাকায় পরিচিত এক কবিরাজ (ওঝা) ছিল, তার এখানে নিয়ে যাওয়া হয় রোকেয়া বেগমকে। তবে রক্ত আর পা ফোলা দেখে ওঝা ফিরিয়ে দেন।
এরপর তাকে প্রথমে হরিরামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা কিছু চিকিৎসা দিয়ে রোকেয়াকে মানিকগঞ্জ কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এই করতে করতে সারারাত পার হয়ে যায়।
ভোর ৫টার দিকে তিনি ঢাকায় পৌঁছান। তখন পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল, ফুলে শক্ত হয়ে ‘সিমেন্টের মত রং’ হয়ে যায়। প্রচুর রক্ত যায়। শরীরের বাম পাশ অবশের মত লাগছিল তার।
রোকেয়া বেগম বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অনেক দেরি করে চিকিৎসা শুরু করতে। চিকিৎসক কী সাপে কামড়েছে সেটা জানতে চাচ্ছিলেন। তখন দেবর মোবাইল থেকে সাপের ছবি দেখান। সেই সাপ দেখে চিকিৎসক জানান, এটি রাসেলস ভাইপার।
তিনি বলেন, “প্রথম দফায় ১০ দিন ভর্তি ছিলাম। প্রথমদিকে পাঁচটা করে ইনজেকশন দিত আর রক্ত নিয়ে পরীক্ষা করত। সাথে স্যালাইন চলছে। ১০ দিন পরে ডাক্তার বলল, আপাতত বাড়ি যান। পাঁচদিন পরে আবার আসেন।
“তখন আমার ছেলে বলল, ঢাকাতেই থাকার জন্য। আমি দেবরের বাসায় ছিলাম পাঁচ দিন। কিন্তু শরীর খুব দুর্বল লাগে আর পায়ের জ্বালাও আছে।”
পাঁচ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে চিকিৎসক আবার রোকেয়া বেগমকে ভর্তি করেন। এ সময় অন্যান্য চিকিৎসার সঙ্গে তাকে এক ব্যাগ রক্তও দেওয়া হয়।
“দ্বিতীয় দফায় চিকিৎসার পর শরীর একটু ভাল লাগে, তখন ডাক্তার ছুটি দিছে। আমরা বাড়িত চলে আইছি”, বলেন রোকেয়া বেগম।
শারীরিক দুর্বলতা এখনও রয়ে গেছে জানিয়ে রোকেয়া বেগম বলেন, “এখন শরীরে আগের মতো শক্তি পাই না। কাজ-কর্মও কম করতে পারি।”
একই বাড়ির বাসিন্দা রোকেয়ার ভাবী বলেন, “ওঝার কাছ থেকে এসে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর একটা স্যালাইন দেয়। তারপরও পা ফুলতে ছিল। তখন ডাক্তার বললেন, মানিকগঞ্জে নিয়ে যান। ততক্ষণে ঢাকা থেকে ছেলে (রোকেয়ার ছেলে) আসছে। রাত ১২টা বেজে গেছে। আমরাও খুব ভয় পাইলাম।
“সে (রোকেয়া) কান্নাকাটি করল, বলল, সে যাবে না। তারপরও মানিকগঞ্জের হাসপাতালে নিয়ে গেল। সেখান থেকে তো ঢাকায় গেল।”
রোকেয়ার স্বামী ঘাস কেটে বাড়িতে এসে দেখেন উঠানভর্তি লোকজন। তখন জানতে পারলেন স্ত্রীকে সাপে কামড়েছে। বাম পা কাপড় দিয়ে বাঁধা।
তিনি বলছিলেন, “উপজেলা হাসপাতাল থেকে মানিকগঞ্জ পাঠায়ে দিল। মানিকগঞ্জ নেওয়ার পর বলল, তাড়াতাড়ি ঢাকায় নিয়ে যান। ঢাকার ডাক্তাররা যথেষ্ট পরিমাণ সহায়তা করছে। এখন ঠিক হয়ে আসছে, তবে সাপে যেখানে কামড় দিছিল সেখানে একটু ব্যথা আছে।”
রোকেয়ার স্বামী বলছিলেন, “ভবিষ্যতে কী হবে, এটা চিন্তা-ভাবনার কারণ আছে মনে হয়।”
মানিকগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন মো. মকছেদুল মোমিন বলেন, “সাপে কামড়ালে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিতে হবে। কামড় দেওয়ার পর থেকে ১০০ মিনিট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে হাসপাতালে নিতে হবে।
হরিরামপুর উপজেলার চরাঞ্চলে রাসেলস ভাইপার সাপের উপদ্রপের কথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে জানিয়ে সিভিল সার্জন বলেন, “উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম রয়েছে। প্রাইমারি স্টেজে চিকিৎসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স দেবে।
“আর কর্নেল মালেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম বিষয়ে চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে”, বলেন সিভিল সার্জন।