হাওর ডেস্ক::
সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়টি আদালতেই ফয়সালা করতে হবে বলে সাফ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্দোলনে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হলে ‘আইন নিজস্ব গতিতে চলবে’ বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে রোববার গণভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নে তিনি আরও বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা পাবে।”
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত সফরের দুই সপ্তাহ পর চীনের প্রধানমন্ত্রীর লি চিয়াংয়ের আমন্ত্রণে সোমবার বিকালে বেইজিংয়ে যান শেখ হাসিনা।
এবার চার দিনের সফর শেষ করে বৃহস্পতিবার তার দেশে ফেরার কথা থাকলেও এক দিন আগে বুধবার ফেরেন প্রধানমন্ত্রী।
বিকাল চারটায় গণভবনে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্য অনেক প্রসঙ্গের পাশাপাশি কোটা আন্দোলন নিয়েও প্রশ্ন রাখেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
কোটা আন্দোলন নিয়ে কোটা বাতিল করে পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের আদালতে পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা মামলা করল, সেই মামলাটায় উচ্চ আদালত যদি কোনো রায় দেয়, সেখানে আমাদের তো কিছু করার নেই।
“আদালতে রায় হয়েছে, রায়ের বিরুদ্ধে আমার দাঁড়ানোর কোনো অধিকার নাই। সেটা তো সংবিধানও বলে না। পার্লামেন্টের কার্যপ্রণালিও বলে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আদালত থেকে কোনো রায় না আসে, ততক্ষণ আমাদের কোনো কথা থাকে না। এটা বাস্তবতা, এই বাস্তবতা আমাদের মানতে হবে।”
২০১৭ ও ১৮ সালেও সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে আন্দোলন হয়েছিল। সে সময় সরকার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা বাতিল করে দিয়েছিল। সেই আদেশ হাই কোর্ট অবৈধ ঘোষণার পর ফের আন্দোলনে নেমেছে শিক্ষার্থীরা।
আন্দোলনকারীদের অনড় অবস্থান নিয়ে তিনি বলেন, “এখন যারা আন্দোলন করছে তারা আইন মানবে না, আদালত মানবে না, সংবিধান কী এটা তারা চেনে না। নির্বাহী কাজ করতে হলে, তার যে নীতিমালা বা তার যে ধারা থাকে, সরকার কীভাবে চলে এই সম্পর্কে কোনো ধারণাই এদের নেই, কোনো জ্ঞানই নাই।
“হ্যাঁ, পড়াশোনা করছে, ভালো নাম্বার পাচ্ছে সেটা ঠিক, ভবিষ্যতে এরাও তো নেতৃত্ব দেবে, তো এই ধারণাগুলো দরকার। সংবিধান কী বলে সেটা তাদের জানা উচিত।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এটা (কোটা) যখন আদালতে চলে গেল, আদালতে সেটার সমাধান হবে। আদালতে তো তাদের সুযোগ দিয়েছে, ‘আপনারা আসেন, যুক্তি দেন’। তারা আদালতে যাক, বলুক।
না, তারা রাজপথেই সমাধান করবে।”
কোটা থাকার যুক্তি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের দেশের সব এলাকা তো সমানভাবে উন্নত না, অনগ্রসর সম্প্রদায়ও আছে। সেইসব এলাকার মানুষের কি কোনো অধিকার থাকবে না?
“সেই অধিকারের কথা চিন্তা করে প্রত্যেক জেলা থেকে যেন চাকরি পায়, সেই চিন্তাটাও তো করতে হবে।”
রাজপথে সহিংসতা হলে কঠোর হওয়ার হুঁশিয়ারিও দেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, “রাজপথে আন্দোলন করছে, করতেই থাকবে। তবে কোনো ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারবে না।
“যতক্ষণ তারা শান্তিপূর্ণভাবে করে যাচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না। কিন্তু এর বাইরেও যখন কিছু করবে, পুলিশের গায়ে হাত দেওয়া বা পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করা, এগুলো করতে গেলে তো আইন তার নিজের গতিতে চলবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।“
তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে?
সরকারি চাকরিতে কোটার পক্ষে নিজের অবস্থানও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, “রাষ্ট্র কীভাবে চলবে, সেটা তো আমাদের সংবিধানে দেওয়া আছে। যেখানে সংবিধানে আছে, অনগ্রসর যারা তাদেরকে রাষ্ট্রের কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখতে হবে। তারা কি সংবিধানটা পড়ে দেখেছে কখনও? আর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার কে দিয়েছে?”
শেখ হাসিনা বলেন, “কোটা আন্দোলন করার আগে তো তোদের রেজাল্টগুলো দেখা উচিত ছিল। যে কোথায় তারা দাঁড়িয়েছে!
“দ্বিতীয়টি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?
“মুক্তিযোদ্ধাদের অপরাধটা কী? নিজের জীবন বাজি রেখে, নিজের পরিবার সংসার সব বাদ দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, খেয়ে না খেয়ে, কাদা মাটিতে রোদ বৃষ্টি ঝড় সব উপেক্ষা করে যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে।
“মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় এনে দিয়েছিল বলেই সবাই উচ্চপদে আসীন, আজকে বড় গলায় কথা বলতে পারছে। নইলে পাকিস্তানিদের বুটের লাথি খেয়ে মরতে হত।”
পাকিস্তান আমলে ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলত না এবং ভিসা নিতে হলে করাচিতে যেতে হত জানিয়ে না জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এই ছেলেমেয়েরা তো এটা দেখেনি। এখন তারা লাফাচ্ছে, এমনকি ১৫ বছর ২০ বছর আগের কথাও তারা জানে না।
“বাংলাদেশের অবস্থাটা কী ছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি, সেশন জট। কোনো সেমিস্টার সিস্টেম ছিল না। গ্রেডিং পদ্ধতি ছিল না, বহু সাবজেক্ট ছিল না। বাংলাদেশ থেকে ডিগ্রি করে কেউ বিদেশে গেলে আবার গোড়া থেকে সেই ইন্টারমিডিয়েট থেকে শুরু করতে হত। স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ে আবার শুরু করতে হত।”
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা কী অবস্থায় পড়েছিল, সেই বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “১৫ আগস্টের পর তারা বলতে পারেনি যে, ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধা’। কারণ, হাজার হাজার অফিসার সৈনিক মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান মেরে সাফ করে দিয়েছে।
“মনে হয়েছে পাকিস্তানের প্রদেশ হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশ ফিরে এসেছে। জয়বাংলা স্লোগান ফিরে এসেছে, ৭ মার্চের ভাষণ ফিরে এসেছে। এখন ভালো লাগে না? মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনলে, তাদের গায়ে জ্বর আসে?”
তাহলে সে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিক
মুক্তিযোদ্ধার এক নাতনি কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এখন চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলন করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “তুই চলে আয়, তোর পড়াশোনার দরকার কী? মুক্তিযোদ্ধার নাতি হিসেবে কোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এখন বলে, ‘কোটা লাগবে না’।
“তোকে তো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া উচিত, তোর পড়ালেখা দরকার নাই, বাড়ি গিয়ে বসে থাক। যদি লজ্জা থাকত, তাহলে ভর্তি বাদ দিয়ে তার পরে এসে আন্দোলন করত।”
“কী যে বিচিত্র এই দেশ!”- এ কথা বলে বিস্ময়ও প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, “বিচিত্র এক মানসিকতা। ছয় ঋতুর দেশ তো, ঋতুও বদলায়, মনমানসিকতাও বদলায়।”
কোটা তুলে দেওয়ার ফল কী হয়েছে?
২০১৮ সালে আন্দোলনের মুখে সরকারি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা তুলে দেয় সরকার। সেই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাত জন সন্তান হাই কোর্টে গেলে সম্প্রতি সেই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে।
এর প্রতিক্রিয়ায় সেই পরিপত্র ফিরিয়ে আনা অর্থাৎ কোটা বাতিলের দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু হয়, পরে অবশ্য তারা কোটা সংস্কারের দাবি তুলছে।
গত সপ্তাহে মঙ্গলবার বাদ দিয়ে প্রতি দিনই বাংলা ব্লকেড নামে অবরোধ কর্মসূচিতে যান চলাচল ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়। অবশ্য বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো বাধা দেয় পুলিশ। সেদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ, লাঠিপেটার ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামেও।
আন্দোলনের কারণে বিরক্ত হয়ে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে কোটা তুলে দিয়েছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
আন্দোলনের কারণে বিরক্ত হয়ে ২০১৮ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরি থেকে কোটা তুলে দিয়েছিলেন বলে সংবাদ সম্মেলনে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
চলতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীরা নমনীয় কর্মসূচি দিয়েছে। তারা রাষ্ট্রপতিকে স্মারকলিপি দিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
আপিল বিভাগ অবশ্য হাই কোর্টের রায়ে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা দিয়েছে। আপিল বিভাগে শুনানিতে আন্দোলনকারীদেরও বক্তব্য রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে হাই কোর্টের রায়ের যে বাস্তবায়নযোগ্য অংশ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, সব কোটাই থাকতে হবে, তবে সরকার চাইলে কোটার হার পরিবর্তন করতে পারবে।
২০১৭-১৮ সালের কোটা আন্দোলন চলার সময় কিছু ‘জ্ঞানীগুনী’ ঘরে বসে ‘মিথ্যা অপপ্রচার’ রেকর্ড করে ছেড়ে দিত মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ এই ধরনের ঘটনা দেখে আমি খুবই বিরক্ত হয়ে যাই, তখন এক পর্যায়ে বলি, ‘ঠিক আছে কোটা বাদই দিয়ে দিলাম।’
“সেখানে উদ্দেশ্যটা ছিল, আগে দেখ কোটা বাদ দিলে কী হয়। তো এখন কী অবস্থা হয়েছে? বেশি দুর যাওয়া লাগবে না, এবারই ফরেন সার্ভিসে মাত্র দুজন মেয়ে চান্স পেয়েছে। আর পুলিশ সার্ভিসে মাত্র চারজন মেয়ে চান্স পেয়েছে।“
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যোগ্য প্রার্থী পাওয়া না গেলে অন্য তালিকা থেকে নিয়োগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তারপরেও যখন আন্দোলন শুরু হলো তখন সব বন্ধ করে দিলাম। সেখানে আজকে ফলাফলটা কী দাঁড়াচ্ছে?”
২০১৭ ও ১৮ সালের কোটা আন্দোলনে যে মেয়ে ‘নারী কোটা চাই না, মেধা দিয়ে চাকরি করব’ বলেছিলেন, তিনি চাকরি পেয়েছেন কি না, তিনি বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছেন কি না সে প্রশ্নও রাখেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, “এ ধরনের কথা যদি না বলত, তাহলে কোথাও না কোথাও একটা চাকরি তো পেত।“
কোটা তুলে দেওয়ার পর ২৩ টা জেলার একটা লোকও পুলিশে চাকরি পায়নি। এবং ৪২ বিশেষ বিসিএসে ডাক্তার নিয়োগ ছাড়া বাকিগুলোতে মেয়েদের পিছিয়ে পড়ার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তাহলে কী হল?”
কোটায় নিয়োগ পেলে কি মেধাবী নয়?
অন্য এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আসলে কোটার প্রার্থীদেরও প্রিলিমিনারি, রিটেন, ভাইবা হয়ে আসতে হয়। সেই সময় (চূড়ান্ত ফলে) মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হলে কোটা পাবে। আর সব সময় তো পূরণ হয় না।”
কোটা আর মেধা নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি করাটা একটা কৌশল মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, “তার মানে কি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-পুতিরা কেউ মেধাবী না? শুধু রাজাকারের বাচ্চারা, নাতি-পুতিরা মেধাবী? তাই না?
“কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, যাদেরকে মেধাবী না বলছেন, তাদের হাতে কিন্তু ওরা পরাজিত। যুদ্ধে কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারাই জয়ী হয়েছিল, রাজাকাররা জয়ী হয় নাই। তারা পাকিস্তানিদের পদলেহন করেও পরাজিত হয়েছিল।
“এই কথাটা মনে রাখা উচিত তারা তো পরাজিত হয়েছিল। তাহলে তাদের মেধাটা কোথায়? তাদের মেধাটা কোথায় সেটা আমার প্রশ্ন।”