শামস শামীম::
যোগাযোগ বিড়ম্বিত দুর্গম হাওর-ভাটির জনগণের সহজতর সড়ক যোগাযোগের জন্য বাস্তবায়িত প্রকল্প ‘সুনামগঞ্জ-নেত্রকোণা উড়াল সড়ক’র কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটির কল্যাণে শুধু সুনামগঞ্জ জেলাই নয় হাওরের অপর জেলা নেত্রকোণার মানুষের যোগাযোগও সহজ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কৃষি অর্থনীতি, পর্যটন ও যোগাযোগে লাভবান হবে দুটি জেলা।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর একনেকে ‘হাওর এলাকায় উড়াল সড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’ অনুমোদন লাভ করে। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের ডিপিপিতে ২৬টি প্যাকেজ ধরা হয়েছে। ২০টি অনুমোদিত প্যাকেজের মধ্যে কাজ চলছে ৯টি প্যাকেজের। ১১টি প্যাকেজের কাজের দরপত্র মূল্যায়ণ শেষে নির্মাণকাজ শুরুর অনুমোদন পর্যায়ে রয়েছে। আর ৬টি প্যাকেজের এখনো অনুমোদন মিলেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন বাস্তবায়িত ৯টি প্যাকেজের মধ্যে কোনটির কাজ শতভাগ, কোনটির কাজ নব্বই ভাগ শেষ হয়েছে। এছাড়াও এই প্রকল্পের বিশেষ আকর্ষণ হাওরের উপর দিয়ে ১১ কিলোমিটার উড়াল সড়ক প্যাকেজেরও মূল্যায়ণ শেষে কাজ শুরুর অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। পুরো উড়াল সড়ক প্রকল্পের কাজ শেষ হলে হাওর জেলা সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারাদেশের সার্কেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। যা কৃষি অর্থনীতিতে বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ২০২৬ সালে উড়াল সড়কের কাজ শেষ করার কথা। তবে হাওরের বিদ্যমান বাস্তবতায় নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ করা সম্ভব হবেনা বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। প্রকল্পে রয়েছে ১১ কিলোমিটার উড়াল সড়ক। সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণা জেলার উপর দিয়ে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, মধ্যনগর, ধর্মপাশা এবং নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টা উপজেলা যোগাযোগ উন্নয়নে যুক্ত আছে প্রকল্পটি। বর্তমানে সুনামগঞ্জের তিনটি উপজেলায় ৯টি প্যাকেজে নবারুণ ট্রেডার্স, জামিল ইকবাল এন্টারপ্রাইজ, হামিম এন্ড রাশিদুজ্জামান পিটার এন্টারপ্রাইজ, বসুন্ধরা হাউস, ভাটি বাংলা এন্টার প্রাইজ, মাহবুব এন্টারপ্রাইজ, চ্যালেঞ্জার এন্টারপ্রাইজসহ একাধিক বড়ো নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কাজ বাস্তবায়ন করছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এই প্রকল্পে ৯৭.৮৬ কিলোমিটার অলওয়েদার সড়ক এবং ২০.২৭ কিলোমিটার ইউনিয়ন সড়ক নির্মিত হবে। এছাড়াও ১৬.৫৩ কিলোমিটার ডুবন্ত সড়ক, ২২.৮৬ কিলোমিটার ডুবন্ত ইউনিয়ন ও গ্রাম সড়ক এবং ১০.৮১ কিলোমিটার উড়াল সড়ক নির্মিত হবে। এই প্রকল্পে ৫৭টি সেতু, ১১৮টি কালভার্টও নির্মাণ করার কথা রয়েছে। প্রকল্পে ধর্মপাশা উপজেলায় চারটি সড়ক এবং তাহিরপুর উপজেলায় ৫টি সড়কের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে আরো জানা গেছে তাহিরপুর উপজেলায় বর্তমানে ৫টি প্যাকেজের কাজ চলমান আছে। তাহিরপুর উপজেলা হেডকোয়ার্টার থেকে ভায়া সোলেমানপুর হয়ে মধ্যনগর পর্যন্ত ১৫০০-৫৬৫০ মিটার, এই প্যাকেজে আরো ৪ কিলোমিটার ও ৬ কিলোমিটার সড়কের কাজ চলমান আছে। এই প্যাকেজে সড়কের কাজ প্রায় ২২ ভাগ শেষ হয়ে গেছে। আরেক প্যাকেজে তাহিরপুর-বাদাঘাট হয়ে ৭.৩১৩ কিলোমিটার, ০০-১৩১৭৫ মিটার আরেকটি সড়কের কাজও চলমান আছে। যার গড় কাজ প্রায় ১০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। আরেকটি প্যাকেজে ধর্মপাশা-মধ্যনগর মহেশখলা টেকেরঘাট লাউড়েরগড়-সুনামগঞ্জ পর্যন্ত ১৮৩০০-২৪৪৪০ মিটার সড়কের কাজও প্রায় ১৫ ভাগ শেষ। তাহিরপুরে আনন্দবাজার ইউনিয়ন থেকে লাউড়েরগড় পর্যন্ত ০০-২৭০০ মিটার সড়কের ৩০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ধর্মপাশা উপজেলায়ও একই প্রকল্পে ৪টি প্যাকেজের কাজ চলমান আছে। এর মধ্যে মধ্যনগর জিসি টু বাদাঘাট জিসি বায়া মহেশখলা বাংলাভিটা রোড ১৪৪৪০-২৬০০০ মিটার সড়কের কাজ গত বছর শুরু হয়েছে। বর্তমানে এই সড়কের কাজ প্রায় ৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই উপজেলায় ধর্মপাশা জিসি-জয়শ্রী জিসি ০০-১১০০ মিটার প্রকল্পের কাজ প্রায় ৫০ ভাগ শেষ করা হয়েছে। চামরদানি ইউপিসি টু সাহারকোণা ঘাট রোড ০০-৪০০০ কিলোমিটার সড়কটির কাজও দ্রুত শেষ হওয়ার পথে। এই প্যাকেজের প্রায় ৯০ ভাগ কাজ শেষ করা হয়েছে। এই উপজেলার লংলা পাথারিয়া টু বানারশীপুর-ধর্মপাশা-রাজাপুর-রামদিঘী-বাকেরজোড়া-মধ্যনগর ০০-৮০৫২ মিটার সড়কের প্রায় শতভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর।
ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, এই প্রকল্পটি হাওরবাসীর যোগাযোগ উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যবসা, কৃষি ও পর্যটনকে বিকশিত করবে। কিছু কিছু এলাকায় দ্রুত গতিতে কাজ চলছে। কাজের গতি স্বাভাবিক থাকলে এবং প্রকল্পের কাজ নীতিমালা অনুযায়ী হলে আশা করি নির্ধারিত সময় আগামী বছরই কাজ শেষ হবে। হাওরবাসীও উপকৃত হবেন। তবে দুর্গম হাওরের কাজে তদারকি না থাকলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ইস্টিমেট অনুযায়ী কাজ না করে দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে। যে কারণে কাজ ঠেকসই না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মধ্যনগরের সন্তান অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরবাসীর যোগাযোগ সহজ হলেও প্রকল্পটি হাওরের প্রাণ ও প্রকৃতির উপর প্রভাব ফেলবে। তাই প্রকৃতিকে রক্ষা করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। না হলে উন্নয়নের অভিঘাত আমাদের ভোগ করতে হবে।
সুনামগঞ্জ স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, বহুল কাঙ্খিত উড়াল সড়কের ২৬টি প্যাকেজের মধ্যে ৯টি প্যাকেজের কাজ চলমান আছে। ১১টির দরপত্র শেষে ইভালুয়েশনের পর্যায়ে আছে। আর বাকি চারটি প্যাকেজ এখনো অনুমোদন মিলেনি। অনুমোদিত ধর্মপাশার দুটি প্যাকেজের কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। অন্যান্য গুলোর কাজও যথা নিয়মে চলছে। প্রকৃতি অনুকুলে থাকলে এবং যেভাবে কাজ চলছে এই গতি থাকলে নির্ধারিত সময়ে কাজ প্রায় শেষ করা সম্ভব হবে। এই কাজ শেষ হলে সুনামগঞ্জ জেলা সারাদেশের সঙ্গে সার্কেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। কৃষি অর্থনীতি ও পর্যটনের বিকাশ হবে।