এম কে রায়হান::
মোবাইলের যুগে সময় দেখার জন্য ঘড়ির প্রয়োজন কমলেও, এই যন্ত্রের চাহিদা এখনও তেমন কমেনি। কারণ হয়তো শুধু সময় জানাতে নয়, হাতের ঘড়িটি একজন মানুষের ব্যক্তিত্বও প্রকাশ করে থাকে। তাছাড়া হাতঘড়িতেও লেগেছে প্রযুক্তির উন্নয়নের ছোঁয়া। ব্যাটারি চালিত তিন কাটার ঘড়িতেই সীমাবদ্ধ নয় হাতঘড়ির বাজার। সময়ের পাশাপাশি দিন, তারিখও জানাচ্ছে হাতঘড়ি। কম্পাসের সাহায্যে দিতে পারে দিক নির্দেশনা।
ঢাকার বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, পলওয়েল মার্কেট ও অন্যান্য বড় মার্কেটগুলোতে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ব্র্যান্ডের হাতঘড়ি। এছাড়াও ঢাকার প্রায় সব মার্কেটেই পাওয়া যায় নন-ব্র্যান্ডের ঘড়ি। সাধ ও সাধ্য অনুযায়ী দুই’শ টাকা থেকে শুরু করে পনের লাখ টাকা পর্যন্ত ঘড়ি পাওয়া যাবে এসব মার্কেটে। তবে এখন মানুষ ঘড়ি কিনে সময় দেখার থেকে ফ্যাশনকে প্রাধান্য দেয় বেশি। এমনটাই জানিয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই।
পাটুয়াটুলিতে ঘড়ি ক্রয় করতে আসা সালমান হাসান নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে বলেন, ‘মানুষের জীবনের একটি অংশ ঘড়ি। ঘড়ি শুধু সময়ই বলে না, বাড়ায় সৌন্দর্য। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আগের মত ব্যবহার হয় না ঘড়ি। আমি সৌখিনতার বসেই এখন ব্যবহার করি।’
তানিয়া জাহান নামের আরেক ক্রেতা বলেন, ‘সময় জানার গুরুত্ব আগের থেকে বেড়েছে। কিন্তু মোবাইলের কারণে কমেছে ঘড়ির ব্যবহার। আমরা যারা এখন ঘড়ি ব্যবহার করি তারা আসলে অভ্যাসের কারনেই। অনেক আগে থেকেই পরে আসছি এখন না পড়লে কেমন খালি খালি মনে হয়।’
নুসরাত তাসনিম নামের আরেক ক্রেতা নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে বলেন, ‘হাতে ঘড়ি রাখা এখন সময় দেখার থেকেও বেশি ফ্যাশনে পরিনত হয়েছে। বাজারে এখন বিভিন্ন ডিজাইনের ব্র্যান্ডের ভালো ভালো ঘড়ি পাওয়া যায়, যা অনেক ফ্যাশনেবল।’
তবে ঘড়ির ব্যবসা এখন আর আগের মত নেই বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। একটা সময় দেশের বড় ঘড়ির বাজার হিসেবে পরিচিতি ছিল বায়তুল মোকাররম মার্কেট। একটা সময় ‘মোখলেস অ্যান্ড সন্স’ বিদেশ থেকে নানা ব্র্যান্ডের ঘড়ি আমদানি করত। বিদেশি পর্যবেক্ষকেরাও আসতেন তাদের মেরামতের কাজ দেখতে। কিন্তু এসব এখন শুধু স্মৃতি।
জানতে চাইলে মোখলেস অ্যান্ড সন্স এর সত্ত্বাধিকারী জনাব মোখলেস উদ্দিন নিউজনেক্সটবিডি ডটকম’কে বলেন, ‘এটা এখন আমার কাছে শখের ব্যবসা। ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রেখেছি। আমাদের পরে অনেক দোকানই হয়েছিল, কিন্তু বাজার খারাপ হওয়া শুরু করলে তারা আর টিকতে পারেনি। বায়তুল মোকাররমকে মানুষ এখন ঘড়ির চেয়ে জুয়েলারি মার্কেট হিসেবে বেশি চেনে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার দোকানে আগে ২৫ জন কর্মচারী কাজ করতেন। এখন পাঁচজন কর্মচারী আছেন। আগে এখানে প্রায় ৩০টি ঘড়ির দোকান ছিল, এখন ২০টির মতো আছে। মোবাইল আসার পর থেকেই আসলে ঘড়ির প্রয়োজনীয়তা কমতে থাকে। তবে এখন হাতঘড়ির চেয়ে দেয়ালঘড়ি বেশি বিক্রি হয়।’
তিন দশক ধরে পাটুয়াটুলিতে ঘড়ির ব্যাবসা করছেন এখলাস মোল্লা। তিনি নিউজনেক্সটবিডিকে বলেন, ‘এক সময় এই ব্যাবসায় ছিল জৌলুস ও আভিজাত্য। সেই ব্যাবসা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। ঘড়ির কাটা ঠিকমত ঘুরলেও তাদের ব্যাবসার কাঁটা যেন ঘুরতে চাইছে না। কিছুদিন আগেও এ যন্ত্রটি শোভা পেত মানুষের হাতে হাতে। বর্তমানে সেই স্থান দখল করে নিয়েছে মোবাইল আর বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস। আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে গুটিকয়েক ফ্যাশন সচেতন ব্যক্তি ছাড়া ঘড়ি এখন আর আগের মত ব্যবহার করেন না। বিয়ে কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠানে ঘড়ি উপঢৌকন দেওয়া হতো। তাও বিলুপ্ত হতে চলেছে।’
তবে এখন বেশ কিছু অনলাইনে ঘড়ির বড় একটি বাজার গড়ে উঠছে। যদিও অনলাইনের উপর এখনও মানুষের তেমন বিশ্বাস স্থাপন হয়নি বলে ঘড়ির বাজার তেমন বিকাশ লাভ করতে পারছেনা।
ঘড়ি আবিষ্কারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: সময়কে ধরে রাখার প্রচেষ্টা ছিল মানুষের যুগযুগ ধরে। কখনো সূর্য দেখে, কখনো চন্দ্র দেখে, কখনো শুধু অনুমানের ওপর নির্ভর করে সময় নির্ধারন করত আগের দিনের মানুষেরা। কিন্তু কিভাবে কে কখন ঘড়ি আবিষ্কার করেছিল তার সুনির্দিষ্ট ইতিহাস জানা নেই কারো। মানুষ প্রথম যে ঘড়ি ব্যবহার করত সেটা হল সূর্যঘড়ি। এটি প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি। আনুমানিক সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে মিসর ও ব্যাবিলনে এর উৎপত্তি। এটি আজও টিকে আছে। সেকেন্ড ও মিনিটের কাটা নেই, নেই কোন টিকটিক শব্দ। তবে সময় দেয় একদম নিখুঁত। গোলাকার চাকতিতে একটি নির্দেশক কাঁটা ও দাগ কাটা সময়ের ঘর, এ নিয়েই সূর্যঘড়ি।
১৪ শতাব্দীতে এসে ইউরোপিয়ানরাই এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে প্রথম যান্ত্রিক ঘড়ি আবিষ্কার করেন। কিন্তু ১৪ শতকের দিকে নির্মিত ঘড়িগুলো শুধুমাত্র ঘন্টা নির্দেশ করতে সক্ষম হত, মিনিট বা সেকেন্ড নির্ণয় করতে পারতো না। তাছাড়া বর্তমান ঘড়ির দুই ঘন্টা ছিল সেই ঘড়ির হিসেবে এক দিন, যার মানে একদিনে ঘড়িটি মাত্র দুবার ৩৬০ ডিগ্রী কোণে ঘুড়তে পারতো। অর্থাৎ এই ঘড়ি দিয়ে সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সূক্ষ সময় গণনা করা যেত না। অবশেষে ডাচ জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ার হাইজেন্স ১৬৫৭ সালে এসে সম্পূর্ণ নির্ভুলভাবে মিনিট, সেকেন্ড ও ঘন্টা নির্দেশকারী উন্নতমানের যান্ত্রিক ঘড়ির অর্থাৎ পেন্ডুলাম ঘড়ির নকশা করেন।
১৯০৬ সালে প্রথম পেন্ডুলাম ক্লকের পেছনে প্রথমবারের মতো জুড়ে দেয়া হয় ব্যাটারি। অন্যান্য ঘড়ির চাইতে গোটা বিশ্বে ব্যবহারের জন্য হাতঘড়ি প্রচলন সবচেয়ে বেশি। ১৫২৪ তে, পিটার হেনেলিন প্রথম পকেট ঘড়ি তৈরি করেছিল। ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে, অধিকাংশ ঘড়িই ছিল পকেট ঘড়ি যা শেকলের মাধ্যমে পকেটের সাথে আটকে রাখা হত।। ১৯৭০ সালের আগে, সব ঘড়িতে একটি ঘুর্ণায়মান ঘন্টার কাঁটা এবং একটি দীর্ঘতর মিনিট কাঁটার সঙ্গে একটি নম্বরযুক্ত ডায়াল ছিল। এরপর ডিজিট্যাল ঘড়ি বাজারে আসে। ডিজিটাল ঘড়িতে সময় রাখতে ভেতরে ক্ষুদ্র কম্পিউটার রয়েছে।
সূত্র: নিউজনেক্সটবিডি: