ঝর্ণা মনি : ‘চিৎকার, ক্রন্দন আর শশব্যস্ত আহ্বানের মাঝে/ উল্লাস করছে অন্ধ জনতা/ ওরা বলে, ‘এখন ভোর’/ কিন্তু জীবনপানে তাকিয়ে/ আমি দেখি রাত্রি, ঘোর অমানিশা/ বিদ্যুৎ চমকানো আর বজ্রপাতে মনে হয় দূরে বৃষ্টি হচ্ছে/ কিন্তু বাতাসে বৃষ্টির নাম-গন্ধ নেই/ রক্তের ধারা বইছে প্রবল।’ স্বাধীনতার মহান স্থপতি আর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে ঘাতকরা ঘোর অমানিশায় ঢেকে দিয়েছিল বাংলার আকাশ। পিতৃহন্তারকের কলঙ্ক তিলক সেঁটে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী বীর বাঙালি জাতির ললাটে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের প্রতিবাদে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের কবি মীর গুল খান নাসির ‘ভোর কোথায়’ কবিতার মাধ্যমে এভাবেই তুলে ধরেন শোকাচ্ছন্ন জাতির রক্তাশ্রুকে।
আজ সোমবার, পহেলা আগস্ট, বাঙালির শোকের মাস শুরু। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেই কালরাতে ঘাতকরা শুধু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল,
শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। শত্রুর বুলেট ঝাঁঝরা করেছে বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিণী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়স্বজনকে।
একাত্তরে দেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ১৪ কোটি হাতকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে দেশ-মাতৃকাকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত করে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এনে দিলেন মহান স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবির ভাষায়, ‘বুক যার বাংলাদেশের হৃদয়’। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও যিনি গেয়েছেন অমরত্বের গান। দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন হাজার বছরের বীর বাঙালির গর্বিত ইতিহাস, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
ঘাতকের বুলেট সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে; কিন্তু আদর্শ-চেতনাকে কেড়ে নিতে পারেনি বাঙালি হৃদয় থেকে। সুখি-সমৃদ্ধ ও মর্যাদাশীল বাংলাদেশ গড়ার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আজ প্রতিটি বাঙালির স্বপ্নের মাঝে সঞ্চারিত। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকারে সরকারিভাবে এবং আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান মাসব্যাপি কর্মসূচি নিয়েছে। এসব কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করার পাশাপশি বাংলাদেশ থেকে হত্যা-সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চিরতরে নির্মূল করার শপথ নেবে জাতি।
১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং তার শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে যান। তাদের আগমনে কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ এক বিরাট সংবর্ধনার আয়োজন করে। মিশন স্কুল পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বাংলোতে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন রোগা-পাতলা একটি বালক তাদের পথ আগলে দাঁড়ালেন। হতভম্ব সকল ছাত্র ও শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক বারবার ধমক দিচ্ছেন কিন্তু জেদি, একরোখা, লিকলিকে ছেলেটি নাছোড়বান্দা। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে দাবি আদায় না করে রাস্তা ছাড়বেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলার বাঘ খ্যাত প্রধানমন্ত্রীও অবাক। এতটুকুন ছেলে, অথচ কী অসীম সাহসী, যে কি না শের-ই-বাংলার পথ আগলে দাঁড়ায়! তবুও কণ্ঠে মাধুর্য এনে বললেন, ‘কী চাও তুমি খোকা?’ লিকলিকে বালকের সপ্রতিভ উত্তর, ‘আমাদের স্কুলের একমাত্র ছাত্রাবাসের ছাদ নষ্ট। পানি পড়ে টপটপ করে। ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এ কাজে প্রয়োজন মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা। এটা সারাবার ব্যবস্থা না করে দিলে আমি পথ ছাড়বো না।’ অসম্ভব সাহসী, বিনয়ী আর পরোপকারী ছাত্রটির কথায় মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা মঞ্জুর করে দেন। এই হৃদয়বান মানুষটিই বাংলার মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান।
রাজনৈতিক দীক্ষা নেন স্কুলজীবনেই। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। পাকিস্তান-ভারত দাঙ্গার সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। স্বাধীন পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম আন্দোলনে অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘটে। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আরো অংশ নেন আবদুর রহমান চৌধুরী, অলি আহাদ, দবিরুল ইসলাম প্রমুখ। সাধারণ মানুয়ের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আর মমত্ববোধ থেকেই বিশ্বদ্যিালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে সমর্থন ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তরুণ নেতা মুজিব, যাঁকে আপামর বাঙালি সম্বোধন করত ‘মুজিব ভাই’ নামে। ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হন ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী শেখ মুজিব। ওই বছরের ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানকে এক চরমপত্র দেয়। ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী কাউন্সিল ও মুসলিম লীগ সরকার ২৭ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। ১৯ এপ্রিল এ আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট শেখ মুজিবসহ ছয়জন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। আন্দোলনে নেতৃত্বের কারণে তার ছাত্রত্ব চলে যায়। মুজিবসহ ছয়জনকে বহিষ্কার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৫ টাকা জরিমানা দিয়ে এবং অভিভাবক মারফত মুচলেকা দিয়ে তাঁকে ছাত্রত্ব ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত জানায়। শেখ মুজিব ছাড়া বাকি পাঁচজন শিক্ষাজীবনে ফিরে এলেও, তিনি জরিমানা দিতে অস্বীকৃতি জানান। আজন্ম প্রতিবাদী ও আপসহীন বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সিদ্ধান্ত ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৮ এপ্রিল তাঁকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। ফলে তাঁর শিক্ষাজীবনের অবসান ঘটে। মাথা উঁচু করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা মুজিব মাথা নত না করে বুঝিয়ে দেন বিদ্রোহী কবির অমর রচনাকেই, ‘শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রীর!’
সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজস্ব অবস্থান কোথায় হওয়া উচিত সেটি যেমন বুঝতেন; তেমনিভাবে কে কোথায় যোগ্যতর আসনে অধিষ্ঠিত হবেন তাকে সে জায়গাটিতে যথাসময়ে যথামর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে দিতে ভুল করতেন না মোটেও। আর সে জন্যই দল গোছাতে ১৯৫৭ সালে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলীয় পদে বহাল করেছিলেন নিজেকে। অন্যদিকে, ১৯৭৪ সালে দলের কাউন্সিলে দলীয় পদ ত্যাগ করে সভাপতির পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন শ্রদ্ধাভাজন জননেতা শহীদ কামরুজ্জামান হেনাকে।
বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক ছিল তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্ব আর হিমালয়ের মতো দৃঢ় সাহস। তাঁর কট্টর সমালোচকও তাঁর সামনে সমালোচনা ভুলে গুণমুগ্ধে পরিণত হতেন। আইয়ুবশাহীর ক্ষমতার গদিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ঘোষণা করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি, যা ইতিহাসের ম্যাগনাকার্টা নামে পরিচিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক ও শামসুল হকসহ নিহত হন ১০ বাঙালি। অন্যদিকে, ছয় দফা কর্মসূচি প্রকাশ হওয়ার পর পাকিস্তানি সরকার ও দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কেউ কেউ এর অপব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলার জনগণ এসব প্রতিক্রিয়াশীল ও অপব্যাখ্যাকারীকে প্রত্যাখ্যান করে। এর পর স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছয় দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা ব্যবহারের হুমকি দেয়। তবুও অকুতোভয় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে দলীয় কর্মীদের মাধ্যমে সারা দেশে প্রচারিত হয় সাধারণ মানুষের বাঁচার ছয় দফা দাবি। পাকিস্তানি সরকার ভীতসন্ত্রস্ত ও ক্ষিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করে। এর প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভ বানচাল করার হীন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে পশ্চিমারা। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ ও প্রগতিবাদী আন্দোলনকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আরো ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়। অবশ্য খুব বেশি দিন তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি আইয়ুব সরকার। শুধু তাই নয়, জেনারেল আইয়ুব খান ও তার দোসর মোনায়েম খানকে জানুয়ারিতেই (১৯৬৯) অত্যন্ত অপমানজনকভাবে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জনের কাছে লেজ গুটিয়ে পালাতে হয় লৌহমানব খ্যাত আইয়ুব খানকে।
ব্যক্তিত্বের উচ্চতা, চরিত্রের দৃঢ়তায় বিশ্বের সমসাময়িক নেত্রীবৃন্দকে টপকে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি যেমন ছিলেন সাহসী বিনম্র ও বলিষ্ঠ চিত্তের মানুষ; তেমনি ছিলেন দেশ-মাটি-মানুষকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্য নিঃশঙ্কচিত্ত। তিনি এমনই এক দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ছিলেন, যাঁকে বারবার জেলে নিয়ে নিগৃহীত করে, এমনকি মৃত্যুর ভয় দেখিয়েও পশ্চিমা শাসক-শোষকরা তাঁর মনোবলে এইটুকুন চিড় ধরাতে পারেনি। সব ভয়ভীতি তুচ্ছ করে নির্ভয় ও র্নির্ভার বঙ্গবন্ধু ঘুমন্ত বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তোলার শক্তি আয়ত্ত করে প্রত্যাঘাত হেনে সব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তকে প্রতিহত করেছিলেন। মাথা উঁচু করে বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। বর্বর পাকিস্তানিদের কারাগারে নয় মাস মৃত্যুর প্রহর গুনেছেন, তবুও মাথানত করেননি বঙ্গবন্ধু। চোখের সামনে কবর খোঁড়া হচ্ছে দেখেও মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিবের দৃঢ় উচ্চারণ, ‘আমি প্রথমত বাঙালি, দ্বিতীয়ত মুসলমান। আমরা একবারই মরি, বারবার নয়। বাঙালি মুসলমানরা আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ভারতের সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর। এক কোটি শরণার্থীকে নয় মাস খাদ্যসহ আশ্রয়দান, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ, স্বাধীন বাংলার মুজিবনগর সরকার ও কর্মকর্তাদের বাসস্থান, সর্বোপরি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে যৌথ নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করার মহান অবদানকে মৃত্যু পর্যন্ত স্মরণ করেছেন বঙ্গবন্ধু। তবে দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে স্বাধীন বাংলার মাটিতে ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিও কাম্য ছিল না তাঁর। যুদ্ধপরবর্তী প্রথম সাক্ষাতেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় সিংহ হৃদয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তাই সবিশেষ অনুরোধ করেন, ‘বেহেনজি, বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য আপনি কবে সরিয়ে নেবেন?’ ইন্দিরাজিও হাসতে হাসতে বললেন, ‘এটা হবে আপনার জন্মদিনে আমার উপহার।’ সত্যিকার অর্থে ছয় ফুট দুই ইঞ্চির ঋজু দেহের বুদ্ধিদীপ্ত চোখে মোটা চশমা পরা বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তার সামনে কোনো স্ট্র্যাটেজি খাটে না। সে জন্য বাংলার মাটিতে কোনো বিদেশি সেনা হাঁটে না। বাংলাদেশের মানুষ চলে মাথা উঁচু করে, সগর্বে। আর তাই বঙ্গবন্ধুকে দেয়া কথা রেখেছিলেন ভারতমাতা ইন্দিরা গান্ধী। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের উপহার স্বরূপ স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে নেন তিনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সব সেনাসদস্যকে বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করা হয়, যা বিশ্বের যুদ্ধ ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা।
৫৫ বছরের ক্ষণস্থায়ী জীবনে কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি বঙ্গবন্ধু। এই সংক্ষিপ্ত জীবনের সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন ২৫ বছর তিনি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছেন এবং তা বাস্তবায়নও করতে পেরেছিলেন। বাংলার মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন। উপহার দিয়েছেন মানচিত্র, জাতীয় পতাকা, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় সঙ্গীত। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের সামনেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্ভীক। নিজের জীবনের জন্য তিনি কখনো ভীত ছিলেন না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া ভয়হীন বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও গেয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী গান। পিতৃহন্তারকদের বুলেটে প্রাণ হারানোর সময়ও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি বাঙালির জাতির পিতা। মাথানত করেননি; বরং বিশাল বুক পেতে দিয়েছেন আঠারোটি নির্মম বুলেটের সামনে। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে জন্মভূমির পূণ্য মাটিতে লিখে গেছেন রক্তাক্ত ইতিহাস। রক্ত দিয়েই শোধ করেছেন রক্তের ঋণ। পিতৃহত্যার বিভৎস ভোরে বিশাল ব্যক্তিত্ব আর সাহসের কাছে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল ঘাতকের ঔদ্ধত্য। ইতিহাসের নিমর্ম-নিষ্ঠুরতার মাঝেও ছিল বঙ্গবন্ধুর অসামান্য আপসহীনতার বীরত্বগাথা। কবি তার কাব্যে তুলে এনেছেন সেই ইতিহাস, ‘কী চাস তোরা? বেয়াদবি করছিস কেন?’ গর্জে ওঠে বজ্রকণ্ঠটি/ পাহাড়সম ব্যক্তিত্বের সামনে পড়ে ঘাবড়ে যায় ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দীন/ কাঁপতে কাঁপতে/ হাত থেকে পিস্তল পড়ে যায়/ স্টপ, দিস বাস্টার্ড হ্যাজ নো রাইট টু লিভ/ গর্জে ওঠে ঘাতক নূর চৌধুরীর হাতের স্টেনগানৃ/ মাত্র সাত ফুট দূর থেকে ১৮টি গুলি এসে ঝাঁঝরা করে দেয়/ ধ্রুবতারাটির দেহ।’
কর্মসূচি : প্রতিবারের মতো এবারো ১৫ আগস্টকে সামনে রেখে আগস্টের প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে আওয়ামী লীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর নানা কর্মসূচি। রাত ১২টা ১ মিনিটে শোকের মাসের প্রথম প্রহরে আলোর মিছিলের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির সূচনা করা হয়। মিছিলটি ধানমন্ডি ৩২নং সড়ক ধরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর অভিমুখে যাত্রা করে। অন্যান্য কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে দুপুর ১২টায় টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, দোয়া ও মোনাজাত। বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে রক্তদান কর্মসূচি ও আলোচনা সভা। কৃষক লীগ আয়োজিত বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠেয় এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন শোকের মাসে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।