বিশেষ প্রতিনিধি ::
আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মামুন বলেছেন, এই অঞ্চলের একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা কোনভাবেই পার পাবেনা। দিরাই-শাল্লায় যারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক খসড়া তদন্ত শেষ হয়েছে। চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে আমরা এসেছি বাদী-বিবাদী ও সাক্ষীদের বক্তব্য যাচাই করতে। আমরা ফিরে গিয়ে শীঘ্রই তাদের বিরুদ্ধে চার্জশীট প্রদান করবো। এই এলাকার মানবতাবিরোধী অপরাধীদের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে কেউ অপরাধে জড়িত না হলে তাদেরকে হয়রানি করা হবেনা।
রোববার দিনব্যাপী শাল্লা উপজেলার দৌলতপুর, উজানগাঁও ও দিরাই উপজেলার শ্যামারচর ও পেরুয়াসহ কয়েকটি গ্রামে অভিযোগকারী ও সাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেন আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তদন্ত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা। ভুক্তভোগী ও তাদের স্বজনরা একাত্তরের রাজাকার-আলবদর বাহিনীর বর্বরতা তুলে ধরেন তাদের কাছে। পাশাপাশি সাক্ষী ও শহীদদের স্বজনরা এলাকার অভিযুক্তদের বিষয়ে তথ্যও দেন। তদন্ত দলে ছিলেন প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন, তদন্ত কর্মকর্তা নূর হোসেনসহ ৯ জন। তাঁরা দিনভর একাত্তরের নির্যাতিত, প্রত্যক্ষদর্শী ও শহীদ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন।
জানা গেছে, ভুক্তভোগীরা এলাকার জীবিত রাজাকার ও আল বদর বাহিনীর মধ্যে এখনো যারা জীবিত আছেন তাদের নির্যাতনের তথ্য সংশ্লিষ্টদের কাছে খুলে বলেন। পাশাপাশি দ্রুত বিচার কাজ শেষ করার দাবি জানান তারা। অভিযোগকারী, সাক্ষী ও নির্যাতিতরা তাদের নিরাপত্তা বিষয়েও কথা বলেন।
প্রসিকিউটর (প্রশাসন) জেয়াদ আল মামুন বলেন, প্রাথমিক খসড়া তদন্ত চীফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে জমা দেয়ার পর আমরা সেটার আলোকে অধিকতর তদন্ত করতে এখানে ছুটে এসেছি। কোন প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী যাতে বাদ না পড়ে এবং নিরপরাধ মানুষ প্রতিহিংসা বশত যাতে শাস্তি না পায় সেজন্য আমরা এসেছি। একাত্তরের মানবতাবিরোধীরা রেহাই পাবেনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা মাঠ পর্যায়ে এসেছি প্রকৃত তথ্য যাচাই করতে। ফিরে গিয়ে শীঘ্রই প্রতিবেদন জমা দেব। তিনি বলেন, সাক্ষী, অভিযোগকারী ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রমাণ পেয়েছি কারা কারা মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত। এই এলাকায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহায়তায় নিরপরাধ মানুষের উপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর দিরাই-শাল্লা উপজেলার মিলনস্থল শ্যামারচর এলাকার উজানগাঁও, পেরুয়া, বল্লভপুরসহ কয়েকটি এলাকায় গণহত্যা অগ্নিসংযোগ নারী নির্যাতন লুটপাট চালায় রাজাকার বাহিনী। পিডিবি নেতা আব্দুল খালেক ও ডা. আব্দুস সোবহানের নেতৃত্বে এলাকার প্রায় তিন শতাধিক প্রশিক্ষিত রাজাকার কয়েকটি গ্রামে একযোগে নারকীয় উন্মত্ততায় মেতে ওঠে। এইদিন তারা আশপাশের প্রায় ১০টি গ্রামে হামলা করে। শহীদ হন অন্তত ৪০জন। অর্ধ শতাধিক নারীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। পেরুয়া গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৭ জনকে শ্যামারচার বাজারে উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ধর্মান্তরিত করে সুরমা-নদীর তীরে খেয়াঘাটে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। পরে তাদের ধন-সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। ’৭৫ পরবর্তী পটপরিবর্তনে এলাকায় ফিরে আবার ত্রাসে পরিণত হয় স্বাধীনাতা বিরোধীরা। বর্তমানে প্রভাব প্রতিপত্তি, অর্থবিত্ত ও রাজনীতিতে শীর্ষে থাকায় তারাই এই এলাকা শাসন করছে। ফলে স্বাধীনতার পক্ষের লোকজন এখনো এই এলাকায় কোণঠাসা। ২০১৫ সালে পেরুয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রজনী দাস তার বাবা কালিচরণ দাস ও খালু কুঞ্জমোহন দাসকে হত্যার অভিযোগে কয়েকজনের নামোল্লেখসহ অন্তত ৩০০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেন। অভিযোগের পর ট্রাইব্যুনালের প্রধান আব্দুল হান্নান পিপিএমসহ তদন্ত দল এলাকায় তিনবার এসে তদন্ত করে চীফ প্রসিকিউশনে খসড়া প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। গতকাল রোববার প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মামুন ও রেজিয়া সুলতানা চমনসহ প্রসিকিউশনের কর্মকর্তা ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৯জনের একটি দল আবারও তদন্ত করতে আসেন। তারা অভিযোগের প্রেক্ষিতে অনেকের বক্তব্য গ্রহণ করেন এবং অভিযোগের সত্যতা পান। তদন্ত দল ও প্রসিকিউশনের কর্মকর্তাদের বাদী ও সাক্ষীরা অভিযুক্তদের স্বজনরা তাদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন।