স্টাফ রিপোর্টার::
চলে গেলেন শহিদ জননী আয়শা ওয়াহেদ (৮৫)। সিলেটের নয়াসড়কস্থ মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে বিকেল সাড়ে ৫টায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তিনি জয় বাংলাখ্যাত তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদ তালেব আহমদের মা। কাল বুধবার সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার হাতিয়া গ্রামে তাকে সমাহিত করা হবে।
দিরাই উপজেলার হাতিয়া গ্রামের প্রয়াত আব্দুল ওয়াহেদের সাত ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে তালেব আহমদ ছিলেন সবার বড়। তিনি তখন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকেই তিনি রাজপথে সক্রিয় ছিলেন। একজন প্রভাবশালী উদীয়মান ছাত্র নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন বিশেষ পরিচিতি। শুরু থেকেই তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ৫ নং সেক্টরের বালাট সাব সেক্টরের অগ্রপথিক যোদ্ধা ছিলেন তালেব। সুনামগঞ্জ জেলার মঙ্গলকাটা এলাকার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। পরিচিত ছাত্রনেতা হওয়ার সুবাদে তাকে ধরার পর অন্যদের মনে ভীতি সঞ্চার করতে রাজাকার ও দালালদের প্ররোচনায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে। সুনামগঞ্জ শহরে প্রদর্শন করে নির্যাতনের মাত্রা বাড়াতে থাকে। দালাল-রাজাকার আয়োজিত সভায় তাকে পীছমোড়া করে বেঁধে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলার নির্দেশনা দিলে তিনি উচ্চস্বরে বলতে থাকেন, ‘জয় বাংলা’। যতবার পাকিস্তান জিন্দাবাদের কথা বলা হয়েছে ততবার চরম নির্যাতনর মুখেও তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েেেছন। তাকে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করা হলেও তিনি পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেননি।
সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তিনি ‘জয় বাংলা তালেব’ হিসেবে পরিচিত। বিজয়ের প্রাক্কালে সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবসের দিন ভোরে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের আহসানমারা সেতুর পাশে তাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। তিনিসহ এই দিন ভিন্ন ধর্মাবলম্বি আরো দুই মুক্তিযোদ্ধাকে স্থানীয় জনতা একই কবরে দক্ষিণ সুনামগঞ্জের উজানীগাও উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে শায়িত করেন। স্বাধীনতার পর দিরাই উপজেলা সদরের নামকরণ হয়েছি তালেব নগর নামে। ৭৫ পরে সেটি চাপা পড়ে যায়।
শহিদ হওয়ার আগে অক্টোবর মাসে মাকে দেখতে এসেছিলেন তালেব আহমদ। সেদিন আকাশে ছিল জোছনার মাতামাতি। কোজগরি পূর্ণিমার এই রাতে গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছিলেন মা ও ছেলে। মায়ের হাত ধরে শপথ করেছিলেন দেশ স্বাধীন করে দেশে ফিরবেন। তালেবের আর ফেরা হয়নি। ৩৫ বছর আগে গ্রাম ছেড়ে সিলেটে চলে আসেন মা। তারপর আমৃত্যু এই জননী প্রতিটি জোছনারাতে ছেলের কথা মনে করে অঝোরে কাঁদতেন। জোছনা রাতে নির্ঘুম থাকতেন তিনি। তাকে নিয়ে ২০১৪ সালে কালের কণ্ঠে ‘জোছনা রাতে কাদেন জননী’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সংবাদে জোছনা রাতের ব্যাথাতুর আখ্যান তুলে ধরা হয়েছিল। এই শহিদ জননী নিজ ছেলেকে দেশ স্বাধীন করতে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। তিনি আমতৃ্যু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। এমনকি তার ছেলেকে যারা নির্যাতন করেছিল তাদের নাম ধরে মাঝে মধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। তাদের বিচারের জন্য দাবি জানাতেন। তিনি ছোট ছেলে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও এপিপি এডভোকেট শামছুল ইসলামের সঙ্গে গত ৩০ বছর ধরে সিলেটে অবস্থান করছিলেন।
সোমবার বিকেলে বার্ধ্যক্যজনিত রোগে আয়শা ওয়াহেদকে সিলেটে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হলে মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টায় তিনি মারা যান। হাসপাতালে তাকে দেখতে আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দসহ মুক্তিযোদ্ধারা ছুটে যান।
মরহুমার নাতি আখলাক হোসাইন বলেন, বুধবার শহিদ জননী আয়শা ওয়াহেদকে তার নিজ বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার হাতিয়া গ্রামে সমাহিত করা হবে।
এদিকে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টায় সিলেট শাহী ঈদগাহে মরহুমার প্রথম যানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী কাল বুধবার দিরাইস্থ হাতিয়া গ্রামে দুপুর দুইটায় দ্বিতীয় যানাজা অনুষ্ঠিত শেষে গ্রামে পারিবারিক কবরে দাফন করা হবে।
শহিদ জননী আয়শা ওয়াহেদের মৃত্যুতে সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি পরিষদসহ বিভিন্ন মহল শোক জানিয়েছেন। তারা শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।