আবদুল্লাহ আল নোমান::
বিশ্বখ্যাত নেতা দক্ষিন আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, বিশ্বকে বদলে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী যে অস্ত্রটি আপনি ব্যবহার করতে পারেন, তার নাম শিক্ষা। তাকে পুঁজি করে পৃথিবী আজ এই অবস্থানে এসেছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর বহু দেশের তুলনায় এ দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। শিক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, দেশে শিক্ষার হার ৭০ শতাংশ। কিন্তু এর পক্ষে বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। শিক্ষা, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য প্রভৃতি দিক থেকে পিছিয়ে থাকা জনপদের একটি হলো হাসন-করিম-রাধারমণের জন্মস্থান ভাটি-বাংলা হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ জেলা। গতি কম হলেও বর্তমানে অবশ্য পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
সুনামগঞ্জের তথ্য বাতায়ন বলছে, জেলায় স্বাক্ষরতার হার ৩৫ শতাংশ। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে সুনামগঞ্জে শিক্ষার হার ৩৪.৪ শতাংশ। উপজেলা পর্যায়ে বিশ্বম্ভরপুরে এর হার ২৮.৪ শতাংশ। যাই হোক, শিক্ষায় বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পিছিয়ে আছে তা নির্ধিধায় বলা যায়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য স্কুল-কলেজ সরকারিকরণসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এসবই ইতিবাচক দিক। শুধু সরকারি পদক্ষেপে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন। দরকার ব্যক্তি ও বেসরকারি পর্যায়ের নানা উদ্যোগ। উপজেলার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নকল্পে গঠিত বেসরকারি নানা উদ্যোগের একটি হলো পাবলিক ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস’ অ্যাসোসিয়েশন অব বিশ্বম্ভরপুর, সংক্ষেপে পুসাব এর প্রতিষ্ঠা।
শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসকে গতিশীল করতে, উপজেলার বাসিন্দা দেশের বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসমূহে অধ্যয়নরতদের প্রচেষ্টায় পুসাবের যাত্রা শুরু হয় ২০১৪ সালের ৩০ জুলাই। উপজেলার দিগেন্দ্র বর্মন ডিগ্রি কলেজের (ডিবিডি কলেজ) শহিদ মিনারের পাদদেশে জনা ত্রিশেক স্বপ্নচারীর হাত ধরে শুরু হয় নতুন দিনের পথচলা।
আজ (৩০ জুলাই, ২০১৬) ২য় বছর পার করে ৩য় বর্ষে পা রাখলো এ সংগঠনটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিক্ষার বিস্তারে বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষায় এলাকার শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে কাজ করছে পুসাব। সংক্ষেপে দু’বছরে সংগঠনটির সালতামামি তুলে ধরলে এ স¤পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
সময়ের ব্যবধানে এখন পর্যন্ত পুসাব দু’বার পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান ও কৃতি সংবর্ধনার আয়োজন করেছে। সর্বশেষ গত বছরের এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুনামগঞ্জ-৪ (সদর, বিশ্বম্ভরপুর) আসনের মাননীয় সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বিশ্বম্ভরপুরে একটি কলেজ ও উচ্চ বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা তাঁর প্রতি। দু’বার আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে এসএসসি, এইচএসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে সদ্য ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে পড়–য়া সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মাঝে সহার্দ্যপূর্ণ স¤পর্ক গড়ার মন্ত্রও পাওয়া যায় পুনর্মিলন আয়োজন থেকে। প্রতি বছর বার্ষিক প্রকাশনা ‘সায়র’ প্রকাশ হয় এ অনুষ্ঠানে। সকল সদস্যের তথ্যসংবলিত এ ম্যাগাজিন প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষাসহ অন্যান্য সহায়তার জন্য যাতে সহজে পুসাবের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরামর্শ নিতে পারে।
এ ছাড়া উপজেলার ডিবিডি কলেজে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বিষয়ক কর্মশালা, আলোচনা সভা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান; ক্যরিয়ার বিষয়ক উদ্বোদ্ধকরণ সভা; বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি সহায়ক বই প্রদান; সদ্য ভর্তিকৃত একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে মোটিভেশনাল অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এসব আয়োজনে এলাকার কৃতি সন্তান, যাঁরা দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত- তাঁদের প্রেষনামূলক বক্তব্য ও বিভিন্ন তথ্য প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে ইতিবাচক চিন্তার বিস্তারের প্রয়াসে পুসাবের সদস্যরা কাজ করে চলেছে নিরন্তর। মানবতার বার্তাকে ধারণ করে অর্থ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর পাশে দাঁড়িয়েছে সংগঠনটি। এ বছরের শুরুর দিকে পুসাব তার স্কুলভিত্তিক কার্যক্রম শুরু করে। ১ম দিন বিশ্বম্ভরপুর মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে, পরদিন পলাশ উচ্চ বিদ্যালয়ে এ অনুষ্ঠান হয়। পর্যায়ক্রমে উপজেলার অন্যান্য স্কুলগুলোতে কার্যক্রম পরিচালনা করবে।
শিক্ষার পাশাপাশি এলাকার অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও সোচ্চার পুসাব। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষকে সঙ্গে নিয়ে গত বছরের ৩১ অক্টোবর সুরমা নদীর ওপর নির্মিত আব্দুজ জহুর সেতুতে টোল আদায়ের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে বিশ্বম্ভরপুর সদরে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে সংগঠনটি। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। পরের দিন জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ও অন্যান্য স্থানীয় গনমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে আসে সে খবর। এলাকাবাসীর সম্মিলিত চেষ্টায় আজ সেতুতে আংশিক টোল প্রত্যাহার হয়েছে। এতে পুসাবের ক্ষুদ্র এ অবদানও মনে রাখার মতো।
এসব আয়োজন ছাড়াও প্রতিবছর ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে পুসাব। এ বছরের জুলাইয়ে প্রথমবারের মত জেলার যাদুকাটা নদী, বারেকটিলা ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আয়োজিত হয় বার্ষিক বনভোজন। সদস্যদের মাঝে পার¯পরিক বোঝাপড়ার একটি উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্য হলো এসব অভ্যন্তরীন অনুষ্ঠান আয়োজনের।
গত দু’বছরে এলাকার শিক্ষা উন্নয়নে কতটুকু প্রভাব বিস্তার করতে পারছে তার উপসংহার টানার সময় এখনো আসে নি। সময়ের প্রেক্ষিতে এটুকু বলা যায়, সংগঠনটি উপজেলার বহু মেধাবীকে একই প্ল্যাটফর্মে এনেছে। সময় বাড়–ক, বাড়–ক শিক্ষা আন্দোলনের গতি। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্টের উক্তির সূত্র ধরে বলি, শিক্ষার বিস্তারকে পূঁজি করে পুসাব পিছিয়ে পড়া বিশ্বম্ভরপুরের সভ্যতার রূপায়নে ভুমিকা রাখবে। সংগঠনটির ২য় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সেই প্রত্যাশা রইলো।
লেখক :
সাবেক সভাপতি (১ম কার্যকরী কমিটি), পুসাব এবং শিক্ষার্থী (¯œাতকোত্তর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।