ডেক্স রিপোর্ট::
শক্তিতে না হয় পিছিয়ে, বীরত্বে তো নয়! সামর্থ্যে হয়তো বা তুলনীয় নয়, কিন্তু প্রতিজ্ঞায় তো অতুলনীয়। পরাশক্তি ফ্রান্সের সঙ্গে ক্রোয়েশিয়া তাই লড়াই করেছে চোখে চোখ রেখে।
সিংহের বিক্রমে। সংশপ্তকের দৃঢ়তায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করতেই হলো ক্রোয়েশিয়াকে।
বিশ্বকাপ ফাইনালে রূপকথা তাই পূর্ণতা পায় না। প্রথমবারের মতো শিরোপা জেতা হয় না লাল-সাদায় হূদয় রাঙিয়ে দেওয়া ক্রোয়েশিয়ার। বরং ২০ বছর পর নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতে নেয় ফ্রান্স। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে ধ্রুপদি এক দ্বৈরথে ৪-২ গোলে জিতে সোনার ট্রফিতে চুমু এঁকে দেয় ফ্রান্সের সোনালি প্রজন্ম।
বিশ্বকাপ ফাইনাল অনেক দিন ধরেই ফাইনালের মতো হয় না। গোলের বড্ড আকাল সেখানে।
১৯৯০ থেকেই ধরুন না। সেবার ১-০ গোলে জয় পশ্চিম জার্মানির, পরেরবার টাইব্রেকারে শেষ হাসি ব্রাজিলের। ’৯৮-র ফাইনালেই যা তিন গোল দিয়ে শিরোপা জেতে ফ্রান্স; পরেরবার ব্রাজিল ২-০ ব্যবধানে। এরপর সর্বশেষ তিন ফাইনালে কোনোটিতে নির্ধারিত ৯০ মিনিটে গোল হয়নি। ২০০৬ সালে টাইব্রেকারে ইতালি আর পরের দুইবার যোগ করা ৩০ মিনিট সময়ের গোলে জিতে ট্রফি জয়ের উল্লাসে মাতে স্পেন ও জার্মানি।
সেখানে কিনা কাল ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়া ফাইনালে ছয় গোল! ফাইনালের মতোই ফাইনাল হলো বটে!
মস্কোর এই শিরোপা নির্ধারণী দ্বৈরথের পরতে পরতে ক্রোয়াট দীর্ঘশ্বাস মাখা। ম্যাচের শুরুটা কী দাপটের সঙ্গেই না করেছিল! অথচ খেলার ধারার একেবারে বিপরীতে ১৮তম মিনিটে খেয়ে বসে গোল। সেটিও আত্মঘাতী! গোললাইন থেকে ৩০ গজ দূরে আন্তোয়ান গ্রিয়েজমানকে ফাউল করায় ফ্রি-কিক পায় ফ্রান্স। ম্যাচে সম্ভবত এই ফরাসি ফরোয়ার্ডের সেটিই প্রথম বলে স্পর্শ। বাঁ পায়ে ফ্রি-কিক নিলেন, দঙ্গলের ভেতর তা ক্লিয়ার করতে গিয়ে মারিও মান্দজুকিচের মাথায় লেগে বল চলে যায় জালে।
এই গোলে তো দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়ার কথা ক্রোয়েশিয়ার। তা না, নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়েন লুকা মডরিচ, ইভান পেরিসিচ, মারিও মান্দজুকিচও। সমতাসূচক গোল আদায় করে নেয় রেফারির ম্যাচঘড়ির কাঁটা আধঘণ্টা ছোঁয়ার আগেই। গোলটি যেন একেবারে ট্রেনিং গ্রাউন্ডের। ৪০ গজ দূরের ফ্রি-কিকে মডরিচ বল ভাসান দ্বিতীয় পোস্টে। সেখান থেকে সিমে ফ্রাসাইয়েকো হেড করে বল পাঠান বিপজ্জনক এলাকায়। পেরিসিচের সামনে যায় বল; সময় নেন তিনি। একটি স্পর্শে জায়গা তৈরি করে বাঁ পায়ের বুলেট শট। সেটি ঠেকানোর সাধ্যি হুগো লরি কেন, পৃথিবীর কোনো গোলরক্ষকেরই নেই।
কিন্তু ওই যে, ভাগ্যবিধাতা পক্ষে নেই ক্রোয়েশিয়ার। তাইতো সমতাসূচক গোলের মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফ্রান্স পেয়ে যায় পেনাল্টি। তা-ও ভিএআর সিদ্ধান্তে। গ্রিয়েজমানের কর্নারে ব্লেইস মাতুইদির হেডে ঠিকঠাক লাগাতে পারেননি। পেছনে থাকা পেরিসিচের হাতে লাগে বল। ফরাসিরা আবেদন
করেন পেনাল্টির। ভিএআর দেখে তাতে সায় দেন রেফারি। যদিও তাঁর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ‘ক্লিয়ার অ্যান্ড অবভিয়াস এরর’ ছিল—রিপ্লে দেখে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। পেনাল্টি থেকে গোল করে গ্রিয়েজমান ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে নেন ফ্রান্সকে।
বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রথমার্ধেই তিন গোল! ১৯৭৪-এর পর এমনটা দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম গোলটি ক্রোয়াটরা দিতে পারলে ম্যাচে রোমাঞ্চের রং ছড়াত আরো। কিন্তু তুমুল প্রতিভাবান এই ফ্রান্সের সঙ্গে কতক্ষণ আর পেরে উঠবে তারা! পল পগবার পাস থেকে কিলিয়ান এমবাপ্পে বিদ্যুত্গতির দৌড়ে ডিফেন্ডারকে ছিটকে ফেলে গোলরক্ষকের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর শট ঠেকান সুবাসিচ। ৫৯তম মিনিটে এই দুজনের ওয়ান-টুতে শট পগবার। এর প্রথমটি ফিরলেও ফিরতি বলে বাঁ পায়ের প্লেসিং শটে কিছুই করার থাকে না ক্রোয়াট গোলরক্ষকের। এর মিনিট ছয়েক পর এমবাপ্পের প্রার্থিত গোল। ২৫ গজ দূর থেকে শরীরের ঝাঁকুনিতে ডিফেন্ডারকে বিভ্রান্ত করে জোরালো শটে তাঁর লক্ষ্যভেদ। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের পেলের পর ফাইনালে প্রথম টিনএজার হিসেবে গোল করেন ১৯ বছরের এই তরুণ।
ফ্রান্সের তৃতীয় গোলেই ম্যাচ শেষ, চতুর্থ গোলের পর তো কথাই নেই—এই যখন সবার ভাবনা, তখন ক্রোয়াটদের আবার একটু আশা। ফরাসি গোলরক্ষক লরির অতি চালাকির চেষ্টায় মারিও মান্দজুকিচ বলে পা ছুঁইয়ে দিয়ে দেন গোল। ফ্রান্স ৪ : ক্রোয়েশিয়া ২। নির্ধারিত সময়ের ২১ মিনিট বাকি তখনো। অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়, অভূতপূর্ব কিছু কি করতে পারবে ক্রোয়েশিয়া?
পারেনি। খুব চেষ্টা করা সত্ত্বেও। তাইতো রেফারির শেষ বাঁশির সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সের বাঁধনহারা উল্লাসে ভেসে যাওয়া। আর ক্রোয়েশিয়ার বিষাদের সমুদ্রে ডুব দেওয়া। আনন্দ-বেদনার মহাকাব্যের ক্যানভাস হয়ে ওঠে লুঝনিকির মঞ্চ। সেই গ্যালারির চিলচিত্কার ও সাউন্ডবক্সের কানফাটানো শব্দের মাঝেও যেন উড়ে বেড়ায় আগের দিন ক্রোয়েশিয়ার কোচ জ্লাতকো দালিচের ওই কথাটি।
এটাই ফুটবল! এটাই জীবন!