বিনোদন ডেক্স::
স্বর্ণপামসহ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ট পরিচালক ও পুরস্কারজয়ী ইরানি পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামি আর নেই। ৭৬ বছর বয়সে তিনি গতকাল সোমবার প্যারিসে মারা গেছেন। ‘দ্য টেস্ট অব চেরি’, ক্লোজআপ’, ‘সার্টিফায়েড কপি’র মতো অসাধারণ সব চলচ্চিত্র নির্মাণ করে চলচ্চিত্র জগতে তিনি পেয়েছেন স্থায়ী আসন।
গতকাল ইসনা নিউজ এজেন্সি প্রথম তাঁর মৃত্যুর সংবাদ পরিবেশন করে। ইরানের হাউস অব সিনেমা খবরটির সত্যতা নিশ্চিত করেছে। ইসনা লিখেছে, গত মার্চে শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ায় তিনি চিকিৎসার জন্য ফ্রান্সে অবস্থান করছিলেন।
কিয়ারোস্তামির মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে অস্কারজয়ী ইরানি চলচ্চিত্রকার আসগর ফরহাদি বলেছেন, কিয়ারোস্তামি শুধুই একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন আধুনিক মরমি কবি। চলচ্চিত্রে ও ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন মরমি। তিনি অন্যদের জন্য পথ তৈরি করে গেছেন। শুধু চলচ্চিত্র জগৎই একজন মহান নির্মাতাকে হারাল না, পুরো পৃথিবীই একজন সত্যিকার মহান মানুষকে হারাল।
আরেকজন খ্যাতিমান ইরানি পরিচালক মোহসেন মাখমালবাফ বলেছেন, পুরো পৃথিবীই তাঁর অসাধারণ কাজের কথা জানে, কিন্তু নিজের দেশে তা পুরোপুরি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কিয়ারোস্তামির মাধ্যমেই ইরানি ছবি আন্তর্জাতিক সুনাম পেয়েছে। কিন্তু ইরানে তাঁর ছবিগুলোর প্রদর্শনী সেভাবে হয়নি। তিনি চলচ্চিত্রের ভাষা পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন, হলিউডি ছবির তুলনায় চলচ্চিত্রকে মানবিক করে তুলেছেন। তিনি ছিলেন জীবনীশক্তিসম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি জীবনকে ভালোবাসতেন এবং তাঁর চলচ্চিত্রে জীবনেরই জয়গান গেয়েছেন, তাই মৃত্যুর সঙ্গে তাঁকে মেলানো যায় না। তাঁর মৃত্যুকে মানা যায় না।
কিয়ারোস্তামি ১৯৪০ সালে তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চারুকলায় পড়াশোনা করেন। পাস করার পর তিনি একজন গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। ইরানীয় টেলিভিশনের কমার্শিয়ালের কাজ করেন। এরপর ১৯৬৯ সালে তিনি কানুন-এ (দ্য সেন্টার ফর দ্য ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিলড্রেন অ্যান্ড ইয়ং অ্যাডাল্ট) যোগ দেন, সেখানে তিনি চলচ্চিত্র বিভাগেরই দেখভাল করতেন। এবং তখন থেকেই নিজের ছবিগুলো করতে শুরু করেন কিয়ারোস্তামি।
২০০৫ সালে গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কিয়ারোস্তামি বলেছিলেন, ‘শুরুতে শিশুতোষ সমস্যা নিয়ে চলচ্চিত্রগুলো করা হতো। শুরুতে সেটা ছিল আমার চাকরির অংশ, কিন্তু এই কাজই আমাকে শিল্পী করে তুলেছে।’
কিয়ারোস্তামি তাঁর প্রথম ছবি ‘দ্য রিপোর্ট’ নির্মাণ করেছিলেন ১৯৭৭ সালে। ১৯৯৯ সালে ইরান বিপ্লবের পর অনেক শিল্পীই দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, কিন্তু কিয়ারোস্তামি তখন ইরানেই থেকে গিয়েছিলেন এবং নতুন সরকারের কঠোরতার মধ্যেই নিজের কাজ করে যাচ্ছিলেন। আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকের শুরু পর্যন্ত তাঁর ট্রিলজি ‘হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম (১৯৮৭)’, ‘লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর…’ (১৯৯২) ও ‘থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ’ (১৯৯৪) নির্মাণ করেন। এই ট্রিলজি কখনো বাস্তব, কখনো কল্পনার পথ ধরে চলেছে, কখনো বিবরণ, কখনো তথ্য প্রকাশÍনির্মাণের এই বৈচিত্র্য তখনই বুঝিয়ে দিয়েছে, আব্বাস কিয়ারোস্তামির কাজকে ইচ্ছে করলেই কোনো ছাঁচে ফেলা যাবে না কিংবা তাঁকে কোনো তকমা দেওয়া যাবে না।
কিয়ারোস্তামি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাম দ’রজয়ী হন ১৯৯৭ সালে। তাঁর ‘দ্য টেস্ট অব চেরি’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি এই সম্মান লাভ করেন। এই ছবির পর কিয়ারোস্তামির বিচিত্র সব ভাবনা বিচিত্র সব পথে গিয়েছে এবং তিনি যা নির্মাণ করেছেন, তার সব কটিই অর্জন করেছে নতুন নতুন অর্থ। এমনকি এ সময় ‘এবিসি আফ্রিকা’ বা ‘টেন অন টেন’-এর মতো যে তথ্যচিত্রগুলো নির্মাণ করেছেন, তাও অনন্য। ‘সার্টিফায়েড কপি’, ‘শিরিন’ ও ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’ ছবিগুলোর কথাও এখানে উল্লেখ করা দরকার।
২০১২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘লাইক সামওয়ান ইন লাভ’ ছবিটি যখন যায়, তখন ফিল্মমেকার পত্রিকায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘সিনেমার শুরু আর শেষ আসলে আমাদের একধরনের স্বেচ্ছাচারিতা। ধরেন, এটা একটা নব্বই মিনিটের ফুটবল ম্যাচ। এর বেশিও না, এর কমও না। আমরাই ঠিক করে দিচ্ছি, দর্শক কতক্ষণ থাকবে। সিনেমার বেলায়ও তা-ই। কিন্তু পরিচালকের তো কিছু দায়বদ্ধতা থেকে থাকে। তাই তাকে গল্প শুরু আর শেষ করার একটা জায়গা বেছে নিতেই হয়।’
আব্বাস কিয়ারোস্তামি যে গল্প বলা শুরু করেছিলেন, তার শেষ নেই। তবে সৃজনশীল ও মননশীর চলচ্চিত্রের জন্য তিনি চিরদিন বোদ্ধা ও দর্শক মহলে বেচে থাকবেন।