রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু::
আর্নোল্ড জেটলিন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এক অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সংবাদ বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রেরণ করে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেন। বাংলাদেশে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও পাকিস্তানের নির্মমতা তুলে ধরেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু এখনো অবসর সময়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন।
আর্নোলল্ড জেটলিন চীনের গুয়াংফোড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে সাংবাকিতা পেশায় যোগ দেন। তিনি এপির ব্যুরো চিফ হিসেবে যোগ দেন রাওয়ালপিন্ডিতে। সম্প্রতি তাঁর সাথে খোলামেলা আলোচনা হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। তিনি বলেছেন বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা লক্ষ্য করা গেছে তার কথায়। তিনি টেলিগ্রাফি পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর একটি সাক্ষাৎকারও ছাপেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে পরিবারের সদস্যসহ হত্যার বিস্তারিত সংবাদও কাভার করেছিলেন তিনি।
নি¤েœ তাঁর সাক্ষাৎকারটি হাওর টুয়েন্টিফোরডটনেটের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :
রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কিভাবে যুক্ত হলেন, কিছু বলুন।
আর্নোল্ড রজটলিন : আমি ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি এপির ব্যুরো চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ১৯৭০ সাল থেকে বিশেষ নজর রাখি বাংলাদেশের ওপর। কারণ তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ক্রম পাল্টাচ্ছিল। এর মধ্যেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিমারা জুলুম-নির্যাতন শুরু করেছে। যুদ্ধের আভাস পূর্ব থেকে আঁচ করতে পেরেছিলাম। আমি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্বেই ঢাকাতে অবস্থান করি। আমিই সর্বপ্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সংবাদ বহির্বিশ্বে প্রথম প্রকাশ করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করি। নান ঝূকি নিয়ে আমাকে তখন সংবাদ পাঠাতে হয়েছে। তিনি আতœগোপনে থেকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নজর এড়িয়ে খবর পাঠাতেন বাঙ্গালি নিধনের।
রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু: ১৯৭১ সালে সব বিদেশী সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়। আপনি কিভাবে থাকলেন, এত বৈরি পরিবেশে কাজ করলেন কিভাবে?
আর্নোল্ড জেটলিন : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বেই মার্চের ২০ তারিখ সম্ভবত ঢাকা থেকে সব বিদেশী সাংবাদিকদের বের করে দেওয়া হয়। আমি তখন ঢাকার একটি হোটেলে ছিলাম। সেখানে থেকে এক বন্ধুর মাধ্যমে অন্যত্র আত্মগোপনে চলে যাই। সব সাংবাদিকদের দেশ থেকে বিতাড়িত করলেও আমি জীবনের ঝুঁকি নয়ে থেকে যাই। সন্ধ্যার পর মোটর সাইকেল নিয়ে সংবাদ সংগ্রহে বের হতাম। দিনের বেলা চিনে ফেলতে পারে। পাক আর্মি কর্তৃক বাংলাদেশীদের ওপর চরম নির্যাতন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, নারী ধর্ষণের মতো ঘটনা আমি এপিতে প্রেরণ করেছি এবং বিশ্বের বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় তা গুরুত্বসহকারে প্রচার হয়েছে।
রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু: কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, বলতে গেলে খোদ আমেরিকান প্রশাসন তারপরও আপনারা গুটিকয়েক ব্যক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পলন করলেন। বাংলাদেশের পক্ষে কিভাবে উদ্বুদ্ধু হলেন।
আর্নোল্ড জিটলিন : আমি যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই ঢাবা প্রবেশ করি। আমি দেখেছি বাঙালিদের চোখে-মুখে ঝিলিক দিচ্ছিল স্বাধীনতার স্বপ্ন। একটি স্বাধীন দেশের জন্য তারা কতটা উদগ্রীব। আমি পূর্বাণী হোটেল থেকে ৩২ নম্বরে যেতাম। আমি দেখেছি বঙ্গবন্ধুকে। তাঁর মতো দেশপ্রেমিক লোককে কাছ থেকে দেখা সৌভাগ্যের। শত শত লোক দেখতাম, প্রচুর ভিড় হতো ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে লিপ্ত হন। মূল কথা হচ্ছেÑ বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হয়েছে। কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাা করেছেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল সে। আমরা গুটি কয়েকজন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম এবং মনে হয় বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। বাঙালি জাতির প্রতি কেন জানি একটা মায়া জন্মে যায়। আমরা বিশ্বাস করি বাঙ্গালিকে দাবায়ে রাখা যাবেনা। তারা স্বাধীন হবেই। এই সময়ে সংগ্রামী বাঙ্গালিদের দেখে আমাদের তাই মনে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম। আমার কেন যেন মনে হতো যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা আছে সে দেশ একদিন স্বাধীন হবেই।
রনেন্দ্র তালুকদার পিংকু: দেশে এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
আর্নোল্ড জেটলিন: দেখুন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। দেরিতে হলেও বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে আমার মতে তা আরো অনেক আগে হওয়া উচিত ছিল। এই অধ্যায় শেষ করা উচিত।
অশিতিপরবন্ধু আর্নোল্ড বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এডিটরিয়াল রিসার্চ এবং রিপোর্টে এসোসিয়েটসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০১০ সালে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির সাংবাকিতা বিষয়ক স্কুল থেকে সাংবাদিকতার ওপর এওয়ার্ড পেয়েছেন।